Homeঅর্থনীতিপোশাক খাতে মানবাধিকার সংকট, চ্যালেঞ্জের মুখে বৈশ্বিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড

পোশাক খাতে মানবাধিকার সংকট, চ্যালেঞ্জের মুখে বৈশ্বিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড


২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি বৈশ্বিক ফ্যাশন শিল্পের জন্য ভয়াবহ সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করেছিল। ওই ঘটনার পর প্রাইমার্ক, বেনেটনসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর টনক নড়ে উঠে। ভবিষ্যত বিপর্যয় এড়াতে ক্রেতাদের প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোগী হয়। সরকার, শিল্প উদ্যোক্তা ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে গত একযুগে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তা মান ব্যাপক উন্নত হয়েছে।

এর মধ্যে বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। গত আগস্টে শেখ হাসিনার দেড় দশকের স্বৈরশাসনের পতনের পর রাজনৈতিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে দেশ। ক্ষমতা আকড়ে ধরে রাখার বাসনায় অভ্যুত্থান ঠেকাতে জুলাই-আগস্টে সরকার যে দমন-পীড়ন চালিয়েছে তার মধ্যে সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এসব ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ, যেগুলো অধিকতর তদন্তসাপেক্ষে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হতে পারে।

এমন এক পরিস্থিতিতে নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের পোশাক খাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশের প্রভূত উন্নতি হলেও শ্রমিক অধিকার ও মানবাধিকার পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। পোশাক কারখানাগুলোতে আধুনিক দাসত্ব এবং শিশু নিপীড়নের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে এই যুক্তরাজ্যের সাম্প্রতিক এই গবেষণা প্রতিবেদনে। পোশাক খাতের সরবরাহ শৃঙ্খলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অনেকাংশেই আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোই দায়ী।

নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশন ও গুডওয়েভ ইন্টারন্যাশনালের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্ববাজারের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় পোশাক সরবরাহকারী হলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগ এবং শ্রমিক নিপীড়নের কারণে ক্রমাগত আন্তর্জাতিক নজরদারির মুখে পড়ছে। বিশেষ করে শিশু শ্রম, শ্রম অধিকার লঙ্ঘন, মজুরি বৈষম্য, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ও শ্রমিক নির্যাতনের মতো বিষয়গুলো রপ্তানিকারকদের জন্য গুরুতর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। তবে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মতো এবারো আন্তর্জাতিক পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার মানোন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের পরিবর্তিত বাস্তবতায় সেটা মোক্ষম সুযোগ হতে পারে।

২০২৩ সালের শুরু থেকে ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত প্রায় দুই বছর ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে এই গবেষণা চালানো হয়। কারণ এই দুটি অঞ্চল বাংলাদেশের প্রধান পোশাক উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে বৈশ্বিক বাজার, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য বিপুল পরিমাণ পোশাক রপ্তানি করে। গবেষণার তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের জন্য গুণগত ও পরিমাণগত গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, যা পোশাক শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বাস্তবতা তুলে ধরে। এতে প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক মিলে মোট ১ হাজার ৯৭৪ জন পোশাক শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের পোশাক খাতে এখনও আধুনিক দাসত্ব ও শিশু শ্রমের মতো গুরুতর সমস্যাগুলো বিদ্যমান। এতে দেখা যায়, ৩২ শতাংশ পোশাক শ্রমিক ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম টাকায় কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে ৭ শতাংশ শ্রমিকের আয় আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার নিচে।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের রপ্তানি সরবরাহ শৃঙ্খলে শিশু শ্রমের অস্তিত্ব রয়েছে। বিশেষ করে চুক্তিভিত্তিক কারখানাগুলোতে শিশুদের উপস্থিতি বেশ। গবেষণা প্রতিবেদনে শিশুশ্রমের যে পরিস্থিতি উঠে এসেছে তা আরও উদ্বেগজনক। গবেষণায় অংশ নেওয়া শতভাগ শিশু শ্রমিক অবৈধভাবে নিযুক্ত। তাদের বেশিরভাগকেই আন্তর্জাতিক ও দেশীয় শ্রম আইন লঙ্ঘন করে নিয়োগ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা শোষণ করা হচ্ছে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে সরকার পোশাক শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা (প্রায় ১১৩ মার্কিন ডলার) নির্ধারণ করলেও গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ শ্রমিক মনে করেন, এই আয় দিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন। আর মাত্র ৯ শতাংশ শ্রমিক সঞ্চয় করতে সক্ষম।

অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ও শ্রমিকদের ওপর উৎপাদনের চাপও বড় সমস্যা। গবেষণা অনুযায়ী, প্রায় ৩০ শতাংশ শ্রমিক দৈনিক ১০ ঘণ্টারও বেশি কাজ করেন, যা আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশি শ্রম আইনের সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং এই চিত্রকে ফোর্সড লেবার বা জোরপূর্ব শ্রমের লক্ষণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নারীদের আধিপত্য থাকলেও তাঁদের ক্ষেত্রেই বৈষম্য প্রকট। গবেষণা দেখা যায়, পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় নারী শ্রমিকরা গড়ে মাসে ২,০০০ টাকা (১৮ মার্কিন ডলার) কম মজুরি পান। এছাড়া ৬৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ও ৯০ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী শ্রমিক নিপীড়ন ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন।

সাবকন্ট্রাক্টে পরিচালিত কারখানাগুলোতে শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের হার বেশি, যা সরাসরি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও নৈতিক ব্যবসার মান ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই বিষয়টি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের। কারণ, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে কম দামে পোশাক কেনার লক্ষ্য থাকায় এই প্রবণতা বেশি বেশি ঘটছে। বাংলাদেশের এই শ্রম পরিস্থিতি বৈশ্বিক রিটেইলারদের কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলবে।

অঙ্কুরিত -3

ইউরোপীয় ইউনিয়নের করপোরেট সাসটেইন্যাবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেকটিভ (সিএসডিডিডি), যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্সড লেবার ইমপোর্ট ব্যান ও যুক্তরাজ্যের মডার্ন স্ল্যাভারি অ্যাক্টের মতো নতুন আন্তর্জাতিক শ্রম আইনগুলো উৎপাদনের সকল পর্যায়ে কঠোর মানবাধিকার পরিদর্শন বাধ্যতামূলক করছে। এতে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের উপর চাপ বাড়ছে।

বাংলাদেশের পোশাক খাতের সংকট সমাধানের গবেষণা প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে— সরবরাহ চেইনে স্বচ্ছতা বাড়াতে সরকার ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোকে নিম্নস্তরের সরবরাহকারীদের কার্যক্রম কঠোর পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশ সরকারকে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করা এবং শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। শিশুশ্রম প্রতিরোধে শিশুশ্রম আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা এবং চুক্তিভিত্তিক কারখানাগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সমানাধিকার নিশ্চিত করা এবং নির্যাতন ও হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া কারখানার দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে রপ্তানিকারকরা যাতে চুক্তিবদ্ধ কারখানাগুলোর অবস্থা তদারকি করেন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে ব্যবস্থা নেন, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত