Homeঅর্থনীতিপাহাড়ি জনপদে এক নতুন সম্ভাবনা

পাহাড়ি জনপদে এক নতুন সম্ভাবনা


সুনসান পাহাড়ের গায়ে এবার যেন বাজছে নতুন আশার বাঁশি। আম চাষের পর খাগড়াছড়িতে যেটি এখন সবচেয়ে আলোচিত, সেটি হলো ঝাড়ু ফুলের বাণিজ্যিক চাষাবাদের কারবার। মাটিরাঙ্গা থেকে মহালছড়ি, পানছড়ি থেকে দীঘিনালা—সর্বত্রই এখন ঝাড়ু ফুলের বুনো সুবাস। শুধু পাহাড়ি বনে নয়, ফলের বাগানেও এখন জায়গা করে নিচ্ছে এই নির্জন ফুল, যা বছরের পর বছর অবহেলিত থেকেও এখন হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার প্রতীক। তার প্রমাণও মিলেছে। জেলাতে এখন এক মৌসুমেই ৩৬ কোটি টাকার ঝাড়ু ফুলের বাণিজ্য হচ্ছে; যা অচিরেই বৈদেশিক মুদ্রার জোগান আনতে ক্রমশ পরিণত হতে যাচ্ছে টেকসই রপ্তানি শিল্পে।

ঝাড়ু ফুলের বৈশিষ্ট্য ও উৎপাদনকাল

ঝাড়ু ফুল বা ফুলঝাড়ু তৈরির প্রধান উপকরণ হচ্ছে উলু ফুল। দেশের প্রায় সব এলাকায় পাওয়া গেলেও সাধারণত চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল থেকে বেশি সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত শীতকালে এ ফুল ফোটে। মার্চ মাসে গাছে ফুল আসে। এরপর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংগ্রহ করে শুকানোর পর তা বিক্রি করা হয়।

ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ঝাড়ু ফুল সংগ্রহের মৌসুম। এ ফুলের বিশেষ যত্ন বা পরিচর্যার দরকার হয় না, পানি দিতে হয় না, এমনকি কীটনাশকেরও প্রয়োজন নেই। একেবারে প্রাকৃতিক নিয়মে জন্মে এবং বেড়ে ওঠে। সহজে শিকড় তোলা যায় এবং অন্যত্র রোপণ করা যায়, তাই পাহাড়িদের নিজস্ব বাগান ছাড়াও দুর্গম পাহাড়ে গিয়ে সংগ্রহের প্রবণতাও বাড়ছে। এক আঁটি ঝাড়ু ফুলে ১৮-২০টি ফুল থাকে; যা বিক্রি হয় স্থানীয় হাটে, ১৮-২০ টাকা দরে।

চোখে দেখা দৃশ্য: শ্রম আর সূর্যের মিতালি

সম্প্রতি সদরের কলেজপাড়া ও টার্মিনাল এলাকায় গেলে দেখা মেলে ভিন্ন এক ব্যস্ততা। খোলা আকাশের নিচে নারী-পুরুষ শ্রমিকেরা সূর্যের তাপে ঝাড়ু ফুল শুকাচ্ছেন। কেউ ফুল বেঁধে রাখছেন, কেউবা ট্রাকে তুলছেন। গায়ে ঘাম, চোখে প্রত্যয়। এখান থেকেই ফুলের ঝাড়ু যাচ্ছে সারা দেশে।

বাগান থেকে বাজার: পাহাড়ের হৃদয় কথা বলে

মাটিরাঙ্গা উপজেলার হৃদয়মেম্বারপাড়া গ্রামের রতন ত্রিপুরা ও আপন ত্রিপুরা বলেন, ‘শিকড় তুলে অন্য জায়গায় সহজে ঝাড়ু ফুল লাগানো যায়। কোনো খরচ নেই বলেই বাগান বাড়ছে। যাদের পাহাড় আছে, তারা এখন ফলের বাগানের পাশাপাশি ঝাড়ু ফুলের বাগান করছে।’ এখন শুধু পাহাড় নয়, সমতলেও চলছে ঝাড়ু ফুল চাষের উদ্যোগ। কারণ, এতে ঝুঁকি নেই বললেই চলে, কিন্তু লাভের অঙ্কটা বেশ বড়।

বাজারে প্রতিযোগিতা ও ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ

তবে সবই যেন এতটা সরল নয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ভারত, নেপাল ও মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ঝাড়ু ফুলের কারণে বাজারে দাম কিছুটা কমে গেছে। এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘ভারতের কিছু সীমান্ত দিয়ে মাল আসে, এতে আমাদের ফুলের দাম পড়ে যাচ্ছে। সরকার চোরাই পথ বন্ধ করলে আমরা পাহাড় থেকে আরও বেশি ফুল তুলে বাজারে দিতে পারব।’

ব্যবসার বিস্তার ও শ্রমবাজার

খাগড়াছড়ি সদরের স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. মানিক ও মো. আব্দুল মোতালেব বললেন, ‘১৮টি ঝাড়ু বাঁধতে খরচ পড়ে ২৪ টাকা। এই বছর বাজার বেশ ভালো। বাইরের ব্যবসায়ীরা এসে কিনে ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, সিলেটে নিয়ে যান। প্রতিদিন ১৫-২০ জন শ্রমিক এই মাঠে কাজ করেন। চলতি মৌসুমে এখান থেকে ২০ ট্রাক মাল যাবে।’

ঢাকার ব্যবসায়ী মো. শহীদ, মো. জসিম ও বরিশালের মো. বেলায়েত বলেন, ‘এক ট্রাক ঝাড়ু ফুলে খরচ পড়ে ৬ লাখ টাকা। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি ও লংগদু থেকেও মাল কেনা হয়। মৌসুমে অন্তত ২০ ট্রাক মাল সারা দেশে পাঠানো হয়। দুই মাসের ব্যবসায় অনেক লাভ হয়।’

প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া সম্ভাবনার উৎস

খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মালেক বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে ঝাড়ু ফুল প্রাকৃতিকভাবেই জন্মায়। ভালো লাভ হয় বলে গত কয়েক বছরে বাণিজ্যিক চাষ বেড়েছে। পানি লাগে না, পরিচর্যারও প্রয়োজন নেই; শুধু মাটিতে রোপণ করলেই হচ্ছে।’

খাগড়াছড়ি বন বিভাগের কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা বলেন, ‘ফুলঝাড়ু একসময় অবহেলিত ছিল, এখন দেশজুড়ে প্রচুর চাহিদা। ঢাকাসহ সারা দেশে এর কদর বাড়ছে। বনজ দ্রব্য হিসেবেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১১ লাখ ১৬ হাজার এবং চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মার্চ পর্যন্ত ১৪ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। আমরা আশা করছি, মৌসুম শেষে এই অঙ্ক ১৮ লাখে পৌঁছাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যদি ফুলঝাড়ুর বাগান করতে চায়, আমরা সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত। বিদেশেও রপ্তানি করা গেলে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা সম্ভব হবে।’

সমবায়ের সাফল্য ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন

খাগড়াছড়ি ঝাড়ু ফুল সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নাসির উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জেলার নয়টি উপজেলা থেকে বছরে ছয় শ ট্রাক ঝাড়ু ফুল যায় সারা দেশে। প্রতিটি ট্রাকে খরচ ছয় লাখ টাকা, অর্থাৎ মোট বাণিজ্যিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। প্রতিবছর এই শিল্প আরও বড় হচ্ছে। কয়েক হাজার শ্রমিক এর সঙ্গে জড়িত। তাঁদের পরিবার এখন ভালোভাবে চলছে।’

তবে একটি দুর্ভাবনাও তাঁর কণ্ঠে শোনা যায়। তিনি বলেন, ‘গত বছর থেকে ঝাড়ু ফুলের ওপর রাজস্ব বাড়ানো হয়েছে, এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আগের নিয়মে রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাই।’

এক সম্ভাবনার নাম ঝাড়ু ফুল

এই নিঃশব্দ ফুল যেন হয়ে উঠেছে পাহাড়ের গর্ব। সরকার সঠিকভাবে নজর দিলে, স্থানীয় জনগণ যথাযথভাবে আগুন ও জুমচাষে পাহাড় ধ্বংস না করলে এবং বাজারের চোরাচালান বন্ধ করা গেলে ঝাড়ু ফুল শুধু পাহাড় নয়, পুরো দেশের অর্থনীতির জন্যও আশীর্বাদ হতে পারে। আগামী দিনে এটি হতে পারে নতুন এক রপ্তানি পণ্য, এক অনন্য সম্ভাবনার প্রতীক।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত