নারীদের করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করার দাবি জানিয়েছে উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস নেটওয়ার্ক (ওয়েন্ড)। আজ বুধবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রাক্-বাজেট আলোচনা সভায় এ প্রস্তাব করেন নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সংগঠনটির সভাপতি ড. নাহিদা বিনতে আমিন।
ওয়েন্ড সভাপতি বলেন, ‘বর্তমানে নারীদের জন্য ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক আয় করমুক্ত। এই সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনীতির বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির প্রভাব বিবেচনা করে আগামী বাজেটে এই সীমা পুনর্বিবেচনা করা উচিত। এটি ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অব্যাহতি দেওয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘৬৫ বছরের ওপরের নারীদের রমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬ লাখ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে করমুক্ত আয়ের সীমা ৬ লাখ টাকা করা উচিত।’
নাহিদা বিনতে আমিন বলেন, ‘১০০ শতাংশ নারী মালিকানাধীন কোম্পানির জন্য বেসরকারিভাবে ব্যবসা করা কোম্পানিগুলোর জন্য, এক ব্যক্তির মালিকানাধীন এবং মহিলা উদ্যোক্তাদের মালিকানাধীন কোম্পানির বেসরকারি লিমিটেড কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করপোরেট কর সাড়ে ২৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ করা যেতে পারে। এতে নারী মালিকানাধীন ব্যবসা তৈরি হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।’
সভায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড), বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া চেম্বার অব কমার্স, উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস নেটওয়ার্ক (ওয়েন্ড), অ্যামেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
বেপজার নির্বাহী পরিচালক তানভীর হোসেন বলেন, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলা ছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের অন্য সব জেলায় বিনিয়োগের জন্য পাঁচ বছর এবং বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি জেলাসহ অন্য বিভাগের সব জেলায় বিনিয়োগের জন্য সাত বছরের কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এতে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও এর আশপাশে এবং বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সহজলভ্যতাসহ সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরের কাছের এলাকায় অধিক পরিমাণে শিল্পায়ন হচ্ছে। কিন্তু এসব সুবিধার অভাব রয়েছে এমন এলাকায় আশানুরূপ শিল্পায়ন হচ্ছে না।
তিনি বলেন, দেশের সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রত্যন্ত ও অনুন্নত এলাকাগুলোর বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। এর ফলে সাময়িকভাবে রাজস্বের ওপর কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও বিনিয়োগ ও দীর্ঘ মেয়াদে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়াবে।
বেপজার নির্বাহী পরিচালক বলেন, বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থাভেদে বিনিয়োগকারীদের দেওয়া কর অবকাশ সুবিধার ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে, যা বিনিয়োগ আকর্ষণে সমস্যার সৃষ্টি করছে। এর ফলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সমমর্যাদার দুটি বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থার বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় বেপজা, বেজা, বিডা এবং বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের অধীন সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য সুষম কর অবকাশ সুবিধা ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিনিয়োগ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য রক্ষার পাশাপাশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিচালনাসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় গাড়ি শুল্কমুক্তভাবে আমদানির সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।
বিভিন্ন সেবা গ্রহণের সময় আয়কর বিবরণী বা আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণ-পিএসআর দেখাতে হওয়ায় সেসব সেবার গ্রাহক কমছে, এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর প্রধান বলেন, ‘অনলাইন রিটার্ন হওয়ার কারণে এখন খুব সিম্পলি রিটার্ন দেওয়া যায়। তার পরেও এটাকে আমরা বিবেচনায় নিলাম। আমরা যেটা করছি পিএসআর-এ, যাঁদের ই-টিআইএন দিতে হতো, তাঁদের সবাইকে পিএসআরে নিয়ে আসছি। এবার এটাকে স্প্লিট করব।’
তিনি বলেন, ‘যেগুলোর আমরা রিটার্ন এখনই চাই, না হলে হবে না, সেগুলোকে আমরা পিএসআরে নেব। আর কিছুতে আমরা রাখব ই-টিআইএন নেওয়ার ব্যাপারে যে, টিআইএন দেখালেই হবে।’
আগে টিআইএন থাকলেও যাঁরা আয়কর রিটার্ন দিতেন না, তাঁদেরই মূলত করের আওতায় আনতে পিএসআর চালু করা হয়েছিল তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এখন থেকে কর্মকর্তারা সক্রিয় থাকায় সে সুযোগ থাকবে না। বাকিটা আমাদের লোকেরা…, টিআইএন নেওয়ার পরে কিন্তু তিনি ঘুমাইতে পারবেন না। আমাদের অফিসাররা আপনাকে নোটিশ করবে। তাঁকে রিটার্ন দেওয়ার জন্য বলবে। আলটিমেটলি সে একই কথা। তাঁর থেকে পিএসআর দেওয়াই ভালো। তারপরও আপনারা বলছেন, আমরা ওইভাবে কাজ করব।’
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, দেশে এক কোটির বেশি মানুষের টিআইএন থাকলেও আয়কর বিবরণী দেন তাঁদের মধ্যে কেবল ৪০ শতাংশের মতো।
যাঁরা কম হারে কর দেন, আসছে বাজেটে তাঁদের ওপরও করের বোঝা বাড়বে বলে সতর্ক করে দেন এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, এনবিআরের লক্ষ্য হচ্ছে, কর অব্যাহতি থেকে বের হয়ে আসা। কারণ, এনবিআর যে পরিমাণ কর আদায় করে সমপরিমাণ ছেড়ে দেয়, অব্যাহতি দেয়।
আবদুর রহমান খান বলেন, ‘আমাদের ওপর কিন্তু হিউজ প্রেশার তৈরি হচ্ছে, সে কারণে যাঁরা যাঁরা একজেম্পটেড ইনকামে (কর অব্যাহতির সুবিধাপ্রাপ্ত) আছেন, তাঁদের একজেম্পশন উঠে যাবে ধীরে ধীরে। এবারই একটা বড় উদাহরণ আপনারা দেখতে পাবেন। বেশ কিছু একজেম্পশন উইথড্র করেছি। বাকিগুলো আপনারা বাজেটে দেখতে পাবেন।’
‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশে’ এত বৈষম্য থাকবে কেন প্রশ্ন তুলে আবদুর রহমান বলেন, ‘যারা রিডিউসড রেটে ট্যাক্স (হ্রাসকৃত হারে কর) দেয়, আপনি যদি বলেন যে আপনার একটা সাপোর্ট লাগবে, সেটা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সারা জীবনের জন্য হতে পারে না। আপনি পাঁচ বছর সাপোর্ট পেয়েছেন বা ছয় বছর, দশ বছর সাপোর্ট পেয়েছেন, শুড বি এনাফ।’
অনুষ্ঠানে বেজার পরিচালক মুহাম্মদ ইমতিয়াজ হাসান বলেন, ‘বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা, ২০০৮ এর বিধান অনুযায়ী বন্ড লাইসেন্স প্রদান করা হতো। ২০১৭ সালে ওই বিধিমালার বিধি-৪ এ প্রয়োগ অনুচ্ছেদে অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপিত ওয়্যারহাউসের অনুকূলে বন্ড লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টি সংযোজন করা হয়। এই বিধানের ফলে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগকারী হান্টসম্যান বাংলাদেশ ওয়্যারহাউস হিসেবে বন্ড লাইসেন্স গ্রহণ করেছে। ২০২৪-২৫ সালের ও বাজেটে পূর্বের বিধিমালাটি বাতিল করে ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা, ২০২৪ জারি করা হয়েছে। কিন্তু, নতুন বিধিমালার বিধি-৪ এর প্রয়োগ অনুচ্ছেদে অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপিত ওয়্যারহাউসের অনুকূলে বন্ড লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ নেই। ফলে জাপানিজ ইকোনমিক জোনে দুজন বিনিয়োগকারীসহ আরও অসংখ্য সম্ভাব্য বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।’
সভায় আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) পক্ষে বাজেট প্রস্তাবনা তুলে ধরেন সংস্থাটির সদস্য ও ফিলিপ মরিস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউর-রহমান-মাহমুদ। তিনি বলেন, ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র (পিএসআর) বাধ্যতামূলক না করে শুধু টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হোক। কার্বোনেটেড বেভারেজে সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি বা এসডি কমানো হোক। মেডিকেল ডিভাইস ও টেকনোলজিতে ভ্যাট হার কমানো হোক।
এর জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, কার্বোনেটেড বেভারেজ জাতীয় পণ্যে কর বাড়ানোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চাপ রয়েছে। এসডি কমাবে না এনবিআর। অন্য বিষয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে। বড়দের যদি এত সুবিধা দেওয়া হয়, তাহলে ছোটরা মারা যাবে।
এনবিআরের সদস্য (কাস্টমস নীতি ও আইসিটি) হোসেন আহমদ বলেন, এক গ্লাস বেভারেজে ১০ চা-চামচ চিনি থাকে। চিনিজাতীয় পণ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করহার বেশি থাকে।
দেশের স্থলবন্দরগুলোর সীমানা এক কিলোমিটার করে বাড়ানোর দাবি জানান ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বারের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ। তিনি বলেন, আমদানি পর্যায়ে মিথ্যা ঘোষণায় ২০০ শতাংশ জরিমানার বিধান রয়েছে। অনেক সময় অনিচ্ছাকৃত ভুলও হয়, সে ক্ষেত্রে ২০০ শতাংশ জরিমানা করা হয়। এ জরিমানার বিধান বিবেচনা ও নারায়ণগঞ্জ বন্দর সচলের দাবিও জানান তিনি।
বিল্ডের সিইও ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণে স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি (এসটিএস) প্রণীত হয়েছে। এরই মধ্যে একটি কমিটি বাংলাদেশের চারটি রপ্তানি খাতের (অ্যাগ্রো এবং অ্যাগ্রো প্রসেসসিং, লেদার এবং লেদারগুডস, জুট এবং জুট প্রসেসিং, ফার্মাসিউটিক্যালস) খাতের রপ্তানি প্রসারে ডাইরেক্ট ক্যাশ-ইনসেনটিভের পরিবর্তে কী ধরনের ডব্লিউটিও কমপ্লায়েন্ট সুবিধা দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে কাজ করছে। এগুলোর মধ্যে ডিউটি ড্র ব্যাক, স্পেশাল বন্ডেড ওয়্যারহাউস, রপ্তানির জন্য সহজ ঋণ, অবকাঠামোগত পরিস্থিতি, নতুন বাজার এবং পণ্য সৃষ্টির জন্য আরঅ্যান্ডডি, পরিবেশসংক্রান্ত এবং অন্যান্য বিষয়ে কমপ্লায়েন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়া ইত্যাদির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
সিইও ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, সকল উৎসে কর্তনকৃত করের জন্য একটি রিফান্ড ব্যবস্থা আয়কর আইনের পৃথক ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। সঠিক রিফান্ড প্রক্রিয়া না থাকায় প্রদানকৃত উৎসে কর বার্ষিক আয়কর রিটার্নের মাধ্যমে সমন্বয় করা হয়, কিন্তু অতিরিক্ত কর ফেরত নেওয়ার বিধান বর্তমান আইনে না থাকার ফলে কর প্রতিপালনে করদাতারা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। আয়কর আইনের ধারা ২১৫, উপধারা ২,৩ বাস্তবায়নকল্পে বিধিমালা অবিলম্বে প্রণয়ন করা দরকার।