Homeঅর্থনীতিদুর্বল ব্যাংকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

দুর্বল ব্যাংকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত


বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এক নতুন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে, যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ব্যক্তির মন্তব্য আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সাধারণ গ্রাহক থেকে শুরু করে ব্যাংকারদের মধ্যেও। যখনই দেশের ব্যাংকিং খাত একটু স্থিতিশীলতার দিকে যেতে শুরু করে, তখনই গভর্নরের হঠাৎ করা মন্তব্য নতুন করে শঙ্কার জন্ম দেয়।

২০২২ সালের আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আকস্মিক জানান, দেশের ১০টি ব্যাংক অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। সে ঘোষণার ফলে ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং আমানতকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দেয়।

এরপর বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গত সেপ্টেম্বরে আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, ওই ১০টি ব্যাংক শুধু দুর্বলই নয়; বরং কার্যত দেউলিয়া দশায় পৌঁছে গেছে। সবশেষ গত মঙ্গলবার সিপিডির এক অনুষ্ঠানে তিনি আরও স্পষ্ট ভাষায় জানান, কিছু ব্যাংককে আর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাঁর এ বক্তব্য ব্যাংকিং খাতের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এবং গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

ব্যাংকিং খাতের অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বক্তব্য সাধারণত স্থিতিশীলতার বার্তা দেয়, যা গ্রাহক ও ব্যাংকারদের মধ্যে আস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু এবারের মন্তব্য নিয়ে ব্যাংখ খাতজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা, পল্টন, কাকরাইল, ফকিরাপুল, মালিবাগ ও রামপুরা এলাকার ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের উদ্বেগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

অনেকে মনে করছেন, গভর্নরের এমন বক্তব্য নিছক অনুমানের ভিত্তিতে নয়; বরং তাঁর কাছে হয়তো নির্দিষ্ট কিছু তথ্য রয়েছে, যা সংকটের গভীরতা নির্দেশ করে। তবে ব্যাংকের নাম প্রকাশ না করায় অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভূত হয়েছে, ফলে ব্যাংকিং খাতে আস্থার সংকট আরও প্রকট হচ্ছে।

এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই বহু গ্রাহক আমানত দ্রুত তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন, যা ব্যাংকগুলোর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি অব্যাহতভাবে চলতে থাকলে এবং সর্বত্র এর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে ব্যাংক খাতের এই নেতিবাচক প্রভাব, সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

ন্যাশনাল ব্যাংকের কলাবাগান শাখার এক গ্রাহক শাহরিয়ার জানান, তিনি ১২ লাখ টাকা ব্যাংকে রেখেছিলেন, যা তুলতে পারেননি। সরকার পরিবর্তনের পরও টাকা তুলতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন। এখন ব্যাংক বন্ধ হলে তিনি সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা ফেরত পাবেন, যা তার জন্য খুবই অস্বস্তিকর। এ কারণেই তিনি দেরি না করে মঙ্গলবার গভর্নরের বক্তব্য শোনার পর বৃহস্পতিবারই টাকা তুলে নিয়েছেন।

একইভাবে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক আহসান উল্লাহ বলেন, ‘গভর্নরের কথা শুনে আমি আমার এফডিআর ভেঙে ফেলেছি। এখন চিন্তা করছি, বিভিন্ন ব্যাংকে ছোট ছোট পরিমাণে টাকা রাখার বিষয়ে। সরকারের ব্যাংকে রাখার বিষয়টিও ভাবছি।’

অন্যদিকে, রাজধানীর মগবাজারে শরিয়াহ পরিচালিত সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, ‘ব্যাংকের অবস্থা খারাপ, এটি নতুন কিছু নয়। সরকার এত দিন সাপোর্ট দেওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হচ্ছিল। কিন্তু গভর্নরের বক্তব্যের পর গ্রাহকেরা আতঙ্কিত হয়ে টাকা তুলতে শুরু করেছেন। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যে বড় অঙ্কের চেক ভাঙানোও কঠিন হয়ে যাবে।’

এবি ব্যাংকের এক গ্রাহক মিরজুমলা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘শুনেছি এবি ব্যাংকের অবস্থা ভালো নয়। তাহলে সেটি কি বন্ধের তালিকায় রয়েছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে এত দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন? এখন কেন এমন ঘোষণা দেওয়া হলো?’

জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। যদি সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা না থাকে, তাহলে এটির টিকে থাকা কঠিন হবে। গভর্নরের বক্তব্যের পর আমাদের চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।’

এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক অবসায়ন বা বন্ধ হয়ে গেলে আমানতকারীরা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা ফেরত পাবেন। অর্থাৎ কেউ যদি কোনো বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যাংকে ১০ লাখ বা ৫০ লাখ টাকা রাখেন, তিনি কেবল ২ লাখ টাকা ফেরত পাবেন।

এ বিষয়ে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ব্যাংকের গ্রাহকদের আর্থিক জ্ঞান বাড়ানো দরকার। শুধু বেশি মুনাফার আশায় দুর্বল ব্যাংকে টাকা রাখা উচিত নয়। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক বন্ধ হলে গ্রাহক ২ লাখ টাকা পাবেন। বিশ্বের সব দেশেই ব্যাংক বন্ধ হয়, বাংলাদেশেও হতে পারে।’

তবে ব্যাংক বন্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের কী পরিকল্পনা রয়েছে, সে সম্পর্কে এখনো স্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। অনেকে মনে করছেন, ব্যাংকের সংকট দীর্ঘদিন ধরে চললেও হঠাৎ করে এমন বক্তব্য দেওয়ায় বাজারে অস্থিরতা আরও বেড়েছে।

ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে চলমান সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও সুস্পষ্ট ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে, কোন ব্যাংকগুলোর অবস্থা সংকটাপন্ন, কোনটি টিকে থাকবে, তা নির্দিষ্টভাবে বলা না হলে পুরো খাতে অনিশ্চয়তা আরও বাড়বে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে আগামী দিনগুলোতে ব্যাংকিং খাতের সংকট আরও গভীর হতে পারে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত