বাংলাদেশে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখা অফিস এবং লিয়াজোঁ অফিস প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও তাদের আয়ের ওপর যথাযথ কর আদায় হচ্ছে না, যার ফলে সরকারের রাজস্বের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শুধু উৎসে কর আদায়ের ওপর সন্তুষ্ট, কিন্তু ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) মনে করে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আয়ের ওপর সরাসরি কর আদায় করা হলে সরকার আরও বিপুল রাজস্ব আহরণ করতে সক্ষম হবে। আইসিএবি তাদের প্রাক্-বাজেট আলোচনায় বিষয়টি তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে কর ফাঁকির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, যা রোধ করতে সরকারকে আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এদিন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের সভাপতিত্বে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক্-বাজেট আলোচনায় দুই দফায় বিভিন্ন পেশাজীবী ও ব্যবসায়িক সংগঠন অংশগ্রহণ করে। প্রথম দফায় বাজেট প্রস্তাবনা তুলে ধরেন ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি), ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি), বাংলাদেশ ট্যাক্স লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ ভ্যাট প্রফেশনাল ফোরামের প্রতিনিধিরা। দ্বিতীয় দফায় বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা), রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব), বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ) এবং বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) প্রতিনিধিরা।
আইসিএবির পক্ষ থেকে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন স্নেহাশীষ বড়ুয়া। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে আয়কারী কোনো প্রতিষ্ঠানকে কর দিতে হয়, তবে বর্তমানে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শুধু উৎসে কর আদায় হচ্ছে, যা যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, গুগল বা আমাজনকে ডিজিটাল সার্ভিসে আনা সম্ভব নয়; কারণ, তারা হয়তো উল্টো ট্যারিফ আরোপ করবে। বড় প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে শুধু উৎসে কর আদায় করা হচ্ছে, কিন্তু তাদের আয়ের ওপর কর আদায় করা উচিত। এটি আইনগত সমস্যা নয়, বরং বাস্তবায়ন সমস্যা। তিনি আরও উল্লেখ করেন, কিছু সরকার টু সরকার চুক্তির মাধ্যমে আসা লেনদেন বাংলাদেশে ধরা পড়ে না।
এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, এই সমস্যা তাঁরা সমাধান করার চেষ্টা করছেন। সরকারি প্রকল্পের বিষয়বস্তুর কাঠামো ঠিক করতে হবে এবং চুক্তির ভেতর বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। প্রকল্পের চুক্তিগুলোর ভেটিং না থাকলে কর ফাঁকির সুযোগ তৈরি হয়, বিশেষত যখন পেমেন্ট দেশের বাইরে হয় এবং কর প্রকিউরমেন্ট এনটিটির ওপর চাপানো হয়। তিনি বলেন, বড় প্রকল্পগুলো, যেমন এক হাজার বা দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, এখানে ব্যবসা করা হলেও কর চাপানো হচ্ছে দেশের সরকারের ওপর, যা বন্ধ করা উচিত।
সরকারি প্রকল্পের বিষয়বস্তুর কাঠামো ঠিক করতে হবে এবং চুক্তির ভেতর বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। প্রকল্পের চুক্তিগুলোর ভেটিং না থাকলে কর ফাঁকির সুযোগ তৈরি হয় আবদুর রহমান খান চেয়ারম্যান, এনবিআর
আইসিএবি জানিয়েছে, জমির মৌজা মূল্য হালনাগাদ না হওয়ার ফলে অপ্রদর্শিত সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সরকারের রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্ত করছে। স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, মৌজা মূল্য বাজারমূল্যের তুলনায় কম থাকার কারণে জমির প্রকৃত মূল্য সরকারি রেকর্ডে প্রতিফলিত হয় না, ফলে করদাতারা তাঁদের সম্পদের প্রকৃত মূল্য প্রকাশ করেন না। মৌজা মূল্য হালনাগাদ করলে সরকারের ডেটাবেইসে প্রকৃত মূল্য অন্তর্ভুক্ত হবে, যা রাজস্ব বাড়াতে সহায়ক হবে।
আইসিএবির প্রস্তাবে জমির বাজারমূল্য হালনাগাদ করে একটি বৃহৎ ডেটাবেইস তৈরির কথা বলা হয়েছে, যা অপ্রদর্শিত সম্পদ কমাতে সাহায্য করবে। স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, মৌজা মূল্য হালনাগাদ না হলে বিক্রেতারা কম মূল্য দেখিয়ে সম্পদের প্রকৃত মূল্য প্রকাশ করেন না, যা রাজস্ব কমাতে এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি বাড়াতে সাহায্য করে। এনবিআরের চেয়ারম্যান প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হলেও জমির রেজিস্ট্রেশন খরচ বাড়ানোর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
এনবিআরের চেয়ারম্যান আরও বলেন, কর ফাঁকির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, বিশেষ করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর থেকে সঠিক কর আদায় নিশ্চিত করতে। তিনি উল্লেখ করেন, বড় প্রকল্পের চুক্তির শর্তাবলি সঠিকভাবে নির্ধারণ না হলে কর ফাঁকির সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা বন্ধ করার জন্য এনবিআর সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে চায়।
১০-১৫ আসনের মাইক্রোবাস বা হাইয়েস গাড়ির ওপর ২০% সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হোক। এতে নছিমন ও লেগুনার ব্যবহার কমবে, মাইক্রোবাসের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, রাজস্ব বাড়বে। আব্দুল হক সভাপতি, বারভিডা
প্রাক্-বাজেট আলোচনায় বারভিডার সভাপতি আব্দুল হক বলেন, ১০-১৫ আসনের মাইক্রোবাস বা হাইয়েস গাড়ির ওপর ২০% সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হোক। এতে নছিমন ও লেগুনার ব্যবহার কমবে, মাইক্রোবাসের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, রাজস্ব বাড়বে এবং নিরাপদ পরিবহনব্যবস্থাও নিশ্চিত হবে। এ ছাড়া শুল্ক কমিয়ে মাইক্রোবাসের দাম কমালে গ্রামাঞ্চলের মানুষও এগুলো ব্যবহার করতে পারবে, যা পরিবহনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনবে।
এ ছাড়া রিহ্যাব নির্মাণ খাতে গেইন ট্যাক্স ৮ থেকে ৪% করার প্রস্তাব দিয়েছে; কারণ, ২০২২ সাল থেকে খাতে মন্দাভাব চলছে। তারা স্ট্যাম্প শুল্ক ১.৫ থেকে ১% এবং স্থানীয় সরকার ফি ৩ থেকে ২% কমানোর প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া নতুন নির্মাণ আইন প্রণয়ন করলে খাতটি পুনরুজ্জীবিত হবে বলে তারা মনে করছে।
আইসিএমএবি তাদের বাজেট প্রস্তাবে ক্লাব নির্বাচনে অগ্রিম আয়কর আদায়ের প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের মতে, সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টে নিবন্ধিত ক্লাবগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অগ্রিম আয়কর পরিশোধ করলে আয়কর নথি না থাকা ব্যক্তিদের করের আওতায় আনা সম্ভব হবে, ফলে রাজস্ব আদায় বাড়বে।
এনবিআরের চেয়ারম্যান কর অব্যাহতির বিষয়ে বলেছেন, ‘কর দিয়ে কেউ দেউলিয়া হয় না।’ তিনি নতুন করে কর অব্যাহতির কোনো পরিকল্পনা না করার পক্ষে অবস্থানের কথা জানান এবং বলেন, সরকারের কাজ হবে চলমান কর প্রথাগুলো পরিমার্জন করা এবং ধীরে ধীরে কর অব্যাহতি তুলে নেওয়া।
এ ছাড়া বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি মুন্নু সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান মইনুল ইসলাম দেশের টাইলস পণ্যের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশ ও স্যানিটারির ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁর মতে, এতে দাম কমবে এবং পণ্যের ব্যবহার বাড়বে।