দ্বিগুণের বেশি প্রস্তাবিত গ্যাসের দাম কার্যকর হলে দেশে নতুন কোনও শিল্প গড়ে উঠবে না। সার্বিকভাবে দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
রবিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ ও ইকোনমিক রিপোর্টারস ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজীত সেমিনারে তারা এসব কথা বলেন। ‘জ্বালানি সহজলভ্যতায় নীতি এবং শিল্প প্রতিযোগিতায় প্রভাব’ শীর্ষক সেমিনারটি রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত হয়।
গত ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এতে শিল্পে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে পুরনোদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়ার কথাও বলা হয়। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আমলে নিয়ে আগামী বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) শুনানি ডেকেছে বিইআরসি।
সেমিনার প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, বুধবার শুনানি থাকায় এ বিষয়ে তার বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে তারা যেন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সে জন্য সব পক্ষের কথা শুনছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার গ্যাস সংকট কাটিয়ে উঠতে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, সরকার নতুন শিল্পের জন্য ১৫০ শতাংশ এবং সম্প্রসারণ শিল্পের জন্য ৫০ শতাংশ গ্যাস দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এমন পরিকল্পনার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। আমরা আর কেউ শিল্প করতে চাই না। তবে বর্তমান শিল্পকে সহায়তা করবেন না, এটা হতে পারে না। সস্তা গ্যাসের কারণে দেশে শিল্প কারখানা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। ব্যাংকে সুদের হার বেশি। এনবিআরেও অন্য সমস্যা আছে। এ অবস্থায় অযৌক্তিকভাবে গ্যাসের দাম বাড়ালে উদ্যোক্তারা কেউ নতুন বিনিয়োগ করবে না। বিদ্যমান ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণও হবে না।
দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিত, উৎপাদন, কর্মসংস্থানসহ অর্থনীতির বেশকিছু সূচক নিম্নমুখী হওয়ায় এ ব্যবসায়ী উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কর্মসংস্থান কমে যাওয়াটা ভয়াবহ ব্যাপার। ছাত্র-জনতার বিপ্লব হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে বেকারত্বের কারণে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী— গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে এ হার ছিল ৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এভাবে বেকারত্ব বাড়াটা কিন্তু দুঃখজনক। বিপ্লবের স্পিরিট ধরের রাখার দায়িত্ব সবার।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গ্যাসের বর্তমান দাম কমানোর উপায় নিয়ে গবেষণা করা দরকার। কমিশন খাওয়ায় জন্য স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কিনতে অস্থির ছিল বিগত সরকারের লোকজন। তারা বিদেশে বসে এখনও কমিশন খাচ্ছে। উদ্যোক্তারা মূলত ফেঁসে গেছেন। গ্যাসের দাম বাড়ানোতো দূরে থাক, কমানো না গেলে শিল্প থাকবে না। সিস্টেম লস কমানোর পাশাপাশি শুল্ক-কর কমিয়ে গ্যাসের দাম কমানো সুযোগ রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন এ ব্যবসায়ী।
বিটিএমএ সভাপতি আরও বলেন, কিছু ব্যাংককে টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ ব্যাংকগুলো লুট হয়েছে। ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখতে টাকা দেওয়া হলেও শিল্প টিকিয়ে রাখার দিকে মনোযোগ নেই। ব্যাংক ঋণের সুদ হার ১৮ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে চলতি মূলধন অর্ধেক কমে গেছে। তিনি আরও বলেন, দেশে এতগুলো চিনিকল থাকতেও পাকিস্তান থেকে চিনি আমদানি হচ্ছে। এটা লজ্জাজনক। এই আমদানির কারণে কিন্তু কর্মসংস্থান হবে না। প্রতিদিন একটু একটু করে বিপদ বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার ১১ টাকা ৫৮ পয়সার গ্যাস বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। ওই সময় শিল্পে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানো হয়। তবে দাম বাড়ানোর পর থেকেই গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা আরও খারাপ হয়। পরবর্তী সময়ে যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। ২০২২ সালের আগে যে শিল্প ইউনিটে গ্যাসের বিল ২ কোটি ১০ টাকা ছিল, দাম বাড়ানোর পর সেটি ৫ কোটি ২৫ লাখ হয়। প্রস্তাবিত মূল্য কার্যকর হলে সেটি বেড়ে হবে ১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে কারখানা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার মতো দেশের কোনও পরিস্থিতি নেই। তাই তিনি সরকারকে এ বিষয়ে আরও সময় চাওয়ার অনুরোধ জানান। প্রায় একই কথা বলেন, ‘ইউরোচ্যাম’-এর প্রেসিডেন্ট নূরিয়া লোপেজ। তিনি বলেন, শুধুমাত্র রাজনীতিবিদ ও আমলারা প্রস্তুত বললেও বাংলাদেশ উত্তরণের পর্যায়ে নেই।
ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ কম এটি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য বিদেশি উদ্যোক্তার মরিয়া হয়ে নাই। অনেকগুলো বিনিয়োগ গন্তব্যের একটি মাত্র এটি, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশে জ্বালানির টেকসই ব্যবস্থাপনা ভালো নয়। একইসঙ্গে মূল্য বৃদ্ধি দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ কখনোই জ্বালানি সংকটের বাইরে ছিল না। তবে বর্তমানে এটি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে। গত ২০১৫-১৬ বছরের দিকে দেশে ২ হাজার ৮০০ এমএফসিএফ গ্যাস উৎপাদন হলেও বর্তমানে তা এক হাজার ৯০০ এমএফসিএফে নেমে এসেছে। এতে যারা বেশি সমস্যায় পড়বে, তাদের জন্য কী করা যায়, তা নিয়ে বড় পরিসরে পরিকল্পনা দরকার।
সেমিনার মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, এখনকার চ্যালেঞ্জিং সময়ে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করা হলে উৎপাদনমুখী খাতে পণ্য উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে। কমবে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। নতুন বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একইসঙ্গে সিমেন্ট, ইস্পাত ও সিরামিক খাতে নতুন করে আমদানি নির্ভরতা বাড়বে। ফলে আর্থিক খাতে চাপ পড়বে। আমদানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রা বেশি লাগবে। মাসরুর রিয়াজ বলেন, আবার গ্যাসের দাম বাড়লে অনেক শিল্প বন্ধ হবে, তখন মন্দ ঋণ বাড়বে।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালা। এতে আরও বক্তব্য দেন বিএসআরএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলী হোসাইন, ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওন প্রমুখ।