Homeঅর্থনীতিখোলা ভোজ্যতেল বিক্রি বন্ধে নেই সরকারি তদারকি

খোলা ভোজ্যতেল বিক্রি বন্ধে নেই সরকারি তদারকি


রাজধানীর কোনাপাড়ার বাসিন্দা খাদিজা বেগম। বাসাবাড়িতে ছুটা বুয়ার কাজ করেন। প্রতিমাসে তার সংসারে চার লিটার ভোজ্যতেল প্রয়োজন হয়। বাজার থেকে খোলা তেল কেনেন তিনি। একই এলাকার ছোট হোটেলের মালিক আব্দুস সোবহান। হোটেলের সব ধরনের রান্না ও ভাজার কাজই সারেন বাজারে বিক্রি হওয়া খোলা তেলে। তারা উভয়েই জানিয়েছেন, খোলা তেলের সুবিধা হলো—যখন যেটুকু প্রয়োজন, তখন ততটুকুই কেনা যায় এবং দামও কম।

আব্দুস সোবহান বলেন, আমরা ব্যবসা ও দৈনন্দিন সাংসারিক কাজে খোলা তেল ব্যবহার করি। বেশি দাম দিয়ে বোতলজাত তেল কেনা সম্ভব আমাদের পক্ষে নয়।

এদিকে প্রায় দেড় বছর আগে সরকারের ঘোষণা ছিল—‘বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি করা যাবে না। সব ধরনের ভোজ্যতেল, বিশেষ করে সয়াবিন তেল বিক্রি করতে হবে প্যাকেটজাত করে। এর কোনও বিকল্প চলবে না।’ সরকারের সেই সিদ্ধান্ত আজও বাস্তবায়ন হয়নি। বলা যায়, ব্যবসায়ীরা কেউই মানছেন না। ফলে বাজারে দেদার বিক্রি হচ্ছে খোলা ড্রামজাত সয়াবিন তেল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,  এই খোলা সয়াবিন তেল মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

জানা গেছে, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে, ওজনে কম দেওয়া রোধ করতে, ভেজাল বন্ধ ও পুষ্টির মান বজায় রাখতে সরকার ২০২৩ সালের ১ আগস্ট থেকে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রির অনুমতি দিবে না বলে জানিয়েছিলেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের তৎকালীন মহাপরিচালক এবং বর্তমান সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব এএইচএম শফিকুজ্জামান।

সরকারের সিদ্ধান্ত মতে বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধ রয়েছে। ২০২৩ সালের ১ আগস্ট থেকে প্যাকেটজাত সয়াবিন তেল ছাড়া খোলা সয়াবিন বিক্রির নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। বিষয়টি তদারকিতে তাৎক্ষণিক মাঠে নেমেছিল জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। জানা যায়, এর কিছু দিন পর থেকেই এই তদারকি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে সারা দেশের হাটবাজার, পাড়ামহল্লার মুদি দোকানে দেদার বিক্রি হচ্ছে খোলা সয়াবিন তেল।

কেন খোলা সয়াবিন বিক্রি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর, এমন প্রশ্নের জবাবে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (প্রগতির জন্য জ্ঞান) প্রজ্ঞা বলেছে, নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি জনগণের অধিকার হলেও ড্রামে বাজারজাতকৃত খোলা ভোজ্যতেল জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইন অনুযায়ী, ভোজ্যতেল ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ ব্যতীত বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ। কিন্তু ড্রামের সয়াবিনসহ বেশির ভাগ খোলা ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ নেই বা পরিমিত মাত্রায় থাকে না। প্লাস্টিকের ড্রাম বারবার ব্যবহারের ফলে ভোজ্যতেল বিষাক্ত হতে পারে। এছাড়া ড্রামের খোলা ভোজ্যতেলে ভেজাল মেশানোর সুযোগ থাকে। ফলে ‘‘ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ আইন, ২০১৩’’ বাস্তবায়নে ড্রামের খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।

প্রজ্ঞা জানিয়েছে, জাতীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট জরিপ ২০১১-১২ অনুযায়ী, দেশে ৬ মাস থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের (অন্তঃসত্ত্বা এবং দুগ্ধদানকারী ব্যতীত) মধ্যে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতিতে ভুগছেন।

আইসিডিডিআর,বি’র অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ভোজ্যতেলের ৬৫ শতাংশই ড্রামে বাজারজাত করা হয়। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশই ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ নয় এবং ৩৪ শতাংশে সঠিক মাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ নেই। ৯৩ শতাংশ ড্রামের খোলা তেলে আইনে নির্ধারিত ন্যূনতম মাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়নি। এসব ড্রামে কোনও ধরনের লেবেল এবং উৎস শনাক্তকরণ তথ্য যুক্ত না করায় তেল সরবরাহের উৎস চিহ্নিত করা যায় না। ফলে কেউ অপরাধ করলে তাদের চিহ্নিত ও আইনের আওতায় আনাও সম্ভব হয় না।

সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল, প্রথম ধাপে শুধু খোলা সয়াবিন বিক্রি বন্ধ করা হবে। আর খোলা পাম ও পাম সুপার তেল বিক্রি হবে। মোড়কজাত সয়াবিন তেল বিক্রি পুরোপুরি নিশ্চিত করা গেলে পরবর্তী ধাপে অন্য তেলও এ নিয়মের আওতায় আনা হবে। অর্থাৎ অন্যান্য তেলও মোড়কজাত করে বিক্রি করতে হবে। সরকার চায়, বাজারে কোনও ধরনের খোলা তেল থাকবে না। ভোজ্যতেলের সব কটি পদই মোড়কজাত করে বিক্রি করতে হবে। কিন্তু এতদিনেও সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাওরান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী দিদারুল আলম বলেন, বাজারে এখানও অনেক ভোক্তা বা ক্রেতা আসেন, যারা খোলা তেল কিনতে চান। যেহেতু ক্রেতা চায়, সেহেতু আমরাও সেটা বিক্রি করি। ক্রেতাদের এমন চাহিদার কারণ কী- প্রশ্নে দিদারুল আলম জানান, খোলা তেলের নানাবিধ সুবিধা আছে।  সেজন্যই  ক্রেতাদের কাছে খোলা সয়াবিনের চাহিদা বেশি। যেমন- একজন ক্রেতা তার সক্ষমতার মাপকাঠি অনুযায়ী চাইলে আধা লিটার বা তার কমও কিনতে পারেন। কিন্তু প্যাকেটজাতে সেই সুবিধা নেই। দ্বিতীয়ত খোলা ভোজ্যতেলের দাম বোতলজাত তেলের তুলনায় কম। মূলত, এসব কারণেই বাজারে এখনও খোলা তেলের চাহিদা আছে।

আমদানিকারকদের সূত্র বলছে, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর ৭০ শতাংশই পাম তেল, বাকি ৩০ শতাংশ সয়াবিন। সয়াবিনের ৫০ শতাংশ খোলা এবং বাকি ৫০ শতাংশ মোড়কজাত করে বিক্রি হয়। বাজারে বর্তমানে সরকার নির্ধারিত খোলা সয়াবিনের দাম প্রতি লিটার ১৭৫ টাকা।

এদিকে তুলনামূলক কম দামে পাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের অনেকেই খোলা সয়াবিন তেলের ওপর নির্ভরশীল বলে জানিয়েছেন পুষ্টি বিজ্ঞানী ডা. আসলাম হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাজারে যারা খোলা তেল বিক্রি করেন, তারা বেশি মুনাফার আশায় করছেন। অপরদিকে যারা তা কেনেন, তারা স্বাস্থ্য সচেতন নয় বলেই কিনছেন। খোলা তেল বিক্রিতে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগও রয়েছে। এক তেলের নামে অন্য তেল বিক্রি, নিম্নমানের ও অস্বাস্থ্যকর তেল বিক্রির পাশাপাশি খোলা অবস্থায় তেল সংরক্ষণ ও বিক্রিতে স্বাস্থ্যঝুঁকিও রয়েছে।’

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বলছে, বাজারে খোলা সয়াবিন তেলা না রাখার ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে দেশের ভোজ্যতেল কোম্পানিগুলো। তারা সেভাবে প্রস্তুতিও নিচ্ছে বলে জানিয়েছে। ক্রমান্বয়ে বাজার থেকে খোলা সয়াবিন বিক্রি বন্ধে কোম্পানি ও দোকানদারদের সঙ্গে কাজ করবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। যদিও বাজার ঘুরে এর প্রতিফলন তেমন একটা দেখা যায়নি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, ‘ভোজ্যতেল খাদ্যপণ্য বিধায় এটি নিরাপদভাবে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার। ড্রামে খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ অবিলম্বে বন্ধ এবং এর ক্ষতি সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে হবে।’





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত