দেশের এসএমই খাতের উন্নয়নে ২০১৯ সালের নীতিমালার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় শিল্প মন্ত্রণালয় তৈরি করছে এসএমই নীতিমালা-২০২৫। তবে এই নীতিমালা বাস্তবায়নে নজরদারির পাশাপাশি বাস্তবায়ন সহযোগী মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলোর অনুকূলে বাজেটে নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন বলে মনে করছে এসএমই ফাউন্ডেশন।
বুধবার (২২ জানুয়ারি) এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এবং অর্থনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠন ‘ইআরএফ’এর সহযোগিতায় ‘এসএমই নীতিমালা-২০২৫: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ: গণমাধ্যমের ভূমিকা’ কর্মশালায় এসব তথ্য জানানো হয়।
ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালার সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মুশফিকুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী এবং ঢাকা চেম্বার সভাপতি তাসকিন আহমেদ। কর্মশালায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান ও মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন। কর্মশালা সঞ্চালনা করেন ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এসএমই ফাউন্ডেশনের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ মোরশেদ আলম।
মূল প্রবন্ধে এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এসএমই নীতিমালা ২০২৫-এর সম্ভাব্য বাস্তবায়নকাল জুলাই ২০২৫ থেকে জুন ২০৩০। নীতিমালায় বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের উন্নয়নে ১০টি কৌশলগত লক্ষ্যের আওতায় ৮৩টি কর্মকৌশল/কৌশলগত হাতিয়ার এবং ৩১০টি কার্যক্রম রয়েছে। প্রতিটি কার্যক্রমের জন্য প্রধান বাস্তবায়নকারী (লিড ও কো-লিড) সংস্থা ছাড়াও সহযোগী বাস্তবায়নকারী (অ্যাসোসিয়েট) মন্ত্রণালয়/সংস্থা নির্ধারণ করা হয়েছে। কর্মকৌশলগুলোকে স্বল্পমেয়াদী (১ বছর), মধ্যমেয়াদী (২-৩ বছর) এবং দীর্ঘমেয়াদী (৪-৫ বছর) ৩ ভাগে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এই নীতিমালা বাস্তবায়নে নিয়মিত সভা আয়োজন, অর্থ বরাদ্দ, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার নজরদারি, ঢাকার বাইরে এসএমই ফাউন্ডেশনের কার্যালয় স্থাপন এবং এসএমই ফাউন্ডেশনকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিরও প্রাণশক্তি কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাত। বাংলাদেশের জিডিপিতে এই খাতের অবদান প্রায় ২৮ শতাংশ। শিল্প খাতের কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫% সিএমএসএমই খাতে। এই খাতের বিকাশ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সরকারি নীতিমালা, কৌশলপত্র ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এসএমই ফাউন্ডেশন। এসব কর্মসূচির অংশ হিসেবে এসএমই উদ্যোক্তাদের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এ যাবত ১১টি জাতীয় এসএমই পণ্য মেলা, ৯১টি আঞ্চলিক ও বিভাগীয় এসএমই পণ্য মেলা, ৪টি হেরিটেজ হ্যান্ডলুম ফেস্টিভ্যাল আয়োজনের পাশাপাশি দুইশো’রও বেশি উদ্যোক্তাকে বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণে সহযোগিতা করেছে এসএমই ফাউন্ডেশন। একজন তৃতীয় লিঙ্গের উদ্যোক্তাসহ ৫৭ জন সফল উদ্যোক্তাকে জাতীয় এসএমই উদ্যোক্তা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। চেম্বার/ট্রেডবডিগুলোর বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, নারী-উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে ব্যাংকারদের উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি, গবেষণা পরিচালনা, নারী-উদ্যোক্তা সম্মেলন ও ক্রেতা-বিক্রেতা সম্মিলন, নারী-উদ্যোক্তা পণ্য মেলা আয়োজন, অনলাইন সাপ্লাইয়ার্স প্ল্যাটফর্ম এবং বিজনেস অ্যাডভাইজরি প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করেছে। সারা দেশের ১৭৭টি এসএমই ক্লাস্টার চিহ্নিত করে ক্লাস্টারভিত্তিক উদ্যোক্তাদের চাহিদার ভিত্তিতে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশে প্রথমবারের মতো রাজশাহীর কালুহাতি পাদুকা ক্লাস্টারে কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টার (সিএফসি) প্রতিষ্ঠা করেছে ফাউন্ডেশন। এ যাবত ক্রেডিট হোলসেলিং কর্মসূচির আওতায় প্রায় ১০ হাজার উদ্যোক্তার মাঝে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। উদ্যোক্তাদের জন্য আইসিটি এনাবল সেবা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ প্রদান, বিভিন্ন সফটওয়্যার সেক্টর ও আইটি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যবসায়িক মেলবন্ধন তৈরি করে ফাউন্ডেশন। ‘গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস’ নিশ্চিত করে পণ্যের মান উন্নীতকরণে সহায়তা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে উৎপাদনশীলতা ও পণ্যের মানোন্নয়নে ‘কাইজেন’ বাস্তবায়নেও সহায়তা করা হয়েছে। ফাউন্ডেশনের সহায়তায় এ পর্যন্ত ৩১টি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান আইএসও সনদ ২২০০০ অর্জন করেছে। এসএমই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা পরিচালনায় শিল্প সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তার লক্ষ্যে ফাউন্ডেশন ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে এসএমই-বান্ধব বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করে আসছে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব এসএমই ডেভেলপমেন্ট প্রকাশ, সমসাময়িক বিষয়ের ওপর গবেষণা পরিচালনা করে ফাউন্ডেশন। উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং উৎপাদনশীলতা ও পণ্যের মানোন্নয়ন, বাজার ও অর্থ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ (ToT) প্রদান করা হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত ২টি বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টারে নতুন ও স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সেবা প্রদান করা হয়।
মো. মুশফিকুর রহমান আরও বলেন, এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের অবদান বাড়ানোর লক্ষ্যে এসএমই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় এসএমই নীতিমালা ২০২৫ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। আমাদের আশা, ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ৩৫ শতাংশে উন্নীত করতে এই নীতিমালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে এই নীতিমালা শতভাগ বাস্তবায়নে এসএমই ফাউন্ডেশনসহ বাস্তবায়ন সহযোগী মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের অনুকূলে নিয়মিত অর্থ বরাদ্দসহ জাতীয় এসএমই উন্নয়ন পরিষদ-এনএসডিসি, এসএমই টাস্কফোর্সসহ সংশ্লিষ্ট কমিটির নিয়মিত সভা এবং সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে শিল্প মন্ত্রণালয় যথাযথ নজরদারি করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের জিডিপিতে সিএমএসএমই খাতের অবদান উন্নত দেশগুলো এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও অনেক কম। পাকিস্তানে এই হার ৪০%, শ্রীলংকায় ৫২%, চীনে ৬০%, ভারতে ৩৭%। এই খাতের বিকাশ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ যাবত সারা দেশে এসএমই ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন কর্মসূচির সুবিধাভোগী প্রায় ২০ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের এসএমই খাতের উন্নয়নে প্রথমবারের মতো এসএমই নীতিমালা অনুমোদন হলেও তা বাস্তবায়নে কোনও অর্থ বরাদ্দ না হওয়ায় নিজস্ব অর্থায়নে এসএমই নীতিমালা ২০১৯-এর আলোকে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে এসএমই ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে রয়েছে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)-এর সহায়তায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে এসএমই ফাউন্ডেশন কর্তৃক ২টি বিজনেস ইনকিউকেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা, ঢাকার আগারগাঁও এ জাতীয় এসএমই ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন, জাতীয় এসএমই ই-ডেটাবেজ’ তৈরি ও পরিচালনা এবং এসএমই ক্লাস্টারসমূহের উন্নয়নের লক্ষ্যে ২২.৯৫ কোটি টাকার ডিপিপি প্রস্তুত করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ। তবে আপনারা জানেন, বাস্তবায়নের এই হার দেশের সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশার তুলনায় খুবই কম। ২০২৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে বাংলাদেশের সিএমএসএমই উদ্যোক্তা ৭৮ লাখ ১৩ হাজারের বেশি। জুলাই বিপ্লবের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসএমই নীতিমালা ২০২৫-কে ঘিরে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। তারা আশা করছেন, এই নীতিমালা শতভাগ বাস্তবায়নে সরকার এসএমই ফাউন্ডেশনসহ বাস্তবায়ন সহযোগী মন্ত্রণালয় ও দপ্তরসমূহের অনুকূলে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রদান করবে, যা শতভাগ শ্রমঘন এই খাতকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ঢাকা চেম্বার সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, এসএমই খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে, অর্থের সীমিত অ্যাক্সেস, উচ্চ সুদের হারের কারণে অর্থায়নের সমস্যা, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত, পর্যাপ্ত নীতিমালার অভাব, পণ্যের বাজারজাতকরণের সমস্যা, যা উত্তরণের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন।