বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কার্যত বন্ধ করে দিয়েছেন আমদানিকারকরা। রমজানকে পুঁজি করে বেশি মুনাফার আশায় দেশি কোম্পানিগুলোর মালিকরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করছেন ভোক্তারা। যদিও এই অভিযোগ সঠিক নয় জানান ব্যবসায়ীরা। আগের যেকোনও সময়ের তুলনায় বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে বলেও দাবি মালিকপক্ষের। রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, রমজানকে সামনে রেখে আবারও সয়াবিন তেলের সংকটে ভুগছেন রাজধানীর মানুষ। গত নভেম্বর মাসেই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত সয়াবিন তেল। এরপর ৯ ডিসেম্বর সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়ানোর পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
এদিকে, গত জানুয়ারি মাসে সয়াবিন তেলের দাম আরেক দফা বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সংগঠন। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দাম বাড়ানোর বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, পরবর্তী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল হবে। এরপর ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে বাজারে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি ভোজ্যতেল সরবরাহ করা হচ্ছে। তাই রমজানে বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহে কোনও সংকটের আশঙ্কা নেই। তবে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ এখনও স্বাভাবিক হয়নি।
সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এবার বেশি পরিমাণে সয়াবিন তেল আমদানি করা হলেও রমজান শুরুর আগেই বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ উঠেছে। দোকানে দোকানে ঘুরেও সহজে মিলছে না সয়াবিন তেল। ভোজ্যতেল নিয়ে রাজধানীর মহল্লাগুলোতেও চলছে একই ধরনের সংকট। কোথাও সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। বাজারে এখন প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম ২১০ টাকায় ঠেকেছে।
বাজার ঘুরে জানা গেছে, সাধারণত খোলা সয়াবিন তেলের দাম বোতলজাত সয়াবিনের তুলনায় কম থাকে। কিন্তু বাস্তবে এখন বোতলজাত সয়াবিনের তুলনায় খোলা সয়াবিনের দাম বেশি। এ অবস্থায় ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বোতলজাত সয়াবিন কম পাচ্ছেন পরিবেশক বা ডিলাররা। ফলে দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেলের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বোতলজাত সয়াবিন তেলের তুলনায় খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১০ টাকা বেশি। বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৭৫ টাকায় বিক্রির জন্য সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও মূলত এই দামে তেল পাওয়া যাচ্ছে না। বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন স্থানভেদে বিক্রি হচ্ছে ১৯৫ থেকে ২০০ টাকা লিটার দরে। আর খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ২১০ টাকা করে। ফলে ১০ টাকা বেশি পাওয়ার লোভে দোকানিরা অনেকেই বোতল খুলে ‘খোলা’ তেল হিসেবে বিক্রি করছেন। ভোক্তারা বেশি দামে এই ‘খোলা’ সয়াবিন কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। পক্ষান্তরে বোতলজাত সয়াবিন পাচ্ছে না তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমদানিকারকরা অপরিশোধিত (ক্রুড) তেল আমদানি করে থাকেন। সেখান কিছু লুজ (খোলা) ও কিছু বোতলজাত করে বিক্রি করা হয়। অর্থাৎ পরিশোধিত একই তেলে মূলত তেমন কোনও পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু বোতলে ভরার প্রক্রিয়াটি। বাংলাদেশে সয়াবিন তেল আমদানির বাজারে প্রধান চারটি প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে টিকে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ এবং এস আলম গ্রুপ প্রধান ভূমিকা পালন করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বসুন্ধরা মাল্টিফুড প্রোডাক্টস এবং আবুল খায়ের গ্রুপের স্মাইল ফুড প্রোডাক্টসের ভোজ্যতেল বাজারে প্রবেশ করেছে। বসুন্ধরা তাদের ‘বসুন্ধরা’ ব্র্যান্ড এবং আবুল খায়ের ‘স্টার শিপ’ ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল বাজারজাত করছে। তবে, একমাত্র বসুন্ধরা ছাড়া এই নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও বাজারে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারেনি। এছাড়া সেনা এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ এবং ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজসহ কয়েকটি নতুন প্রতিষ্ঠানের ভোজ্যতেল বাজারে প্রবেশ করেছে। বাজারে তাদের প্রভাবও সীমিত। জানা গেছে, সম্প্রতি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা বিদেশে যাওয়ার কারণে তাদের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাজার স্বাভাবিক রাখতে সরকার টিসিবির জন্য এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেড থেকে ১৯৬ কোটি টাকার ভোজ্যতেল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানা গেছে, ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো একজোট হয়ে সরকারের কাছে বোতলজাত সয়াবিনের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু সরকার রাজি হয়নি। ফলে ব্যবসায়ীরা কৌশলে মার্কেটে সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি করেছে বলে অভিযোগ ভোক্তাদের। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বোতলজাত সয়াবিন সরবরাহ করা হচ্ছে না। তবে সরকারের কাছে আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২৫ ফেব্রুয়ারির পর বাজার থেকে ভোজ্যতেলের সংকট দূর হবে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) খুচরা দামের তথ্য অনুসারে, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম এখন ১৭৫ থেকে ১৭৬ টাকা। যা গত মাসের তুলনায় প্রায় এক শতাংশ বেশি। গত বছরের তুলনায় সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
এদিকে ক্রেতারা বলছেন, বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহে তেমন উন্নতি হয়নি। এ বিষয়ে শীর্ষ সরবরাহকারীরা জানিয়েছেন মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তারা বলছেন, সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগটি সঠিক নয়। সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার কোনও সুযোগ নাই। রমজান উপলক্ষে স্বাভাবিক নিয়মেই বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়বে। কারণ রমজানে বাজারে সয়াবিন তেলের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
কাওরান বাজারের পাইকারি বিক্রেতা শামসুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তেল নিতে চাইলে কোম্পানিগুলো সঙ্গে পোলাও চাল, হলুদ-মরিচের গুঁড়াসহ বিভিন্ন পণ্য কেনার শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। তবু সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। খুচরা ক্রেতা যখন দুই লিটার তেল কিনতে চান, তাকে যদি বলি— সয়াবিন তেলের সঙ্গে অন্য যেকোনও পণ্য কিনতে হবে, তখন ক্রেতাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয়। এ কারণে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর আমাদের জরিমানাও করছে, আমরা পড়ছি উভয় সংকটে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিত সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রমজানকে কেন্দ্র করে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও যদি সংকট সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে এই সংকটের জন্য আমরা দায়ী না। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দায়ী। বেশি মুনাফার আশায় অতীতেও এ ধরনের ঘটনার কথা আমাদের জানা আছে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের রুটিন দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রহিম খান বলেন, বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট কেটে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি মনিটর করা হচ্ছে। আর রমজানকে কেন্দ্র করে অনৈতিক মুনাফার আশায় দাম বাড়িয়ে বিক্রি করার সুযোগ নাই। আমাদের একাধিক মনিটরিং টিম বাজারে কাজ করছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে চাহিদার তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেশি ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। এই অর্থবছরে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে ২৩ লাখ টন। দেশে ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষা, তিল, তিশিসহ বিভিন্ন ধরনের তেল উৎপাদন হয় ২ লাখ ৫০ হাজার টন। বাকিটা আমদানি করতে হয়। দেশে বছরে মোট ভোজ্যতেলের চাহিদা ২২ -২৩ লাখ টন।