দেশের অর্থনীতির গতি যখন ধীর, মূল্যস্ফীতি চড়া, ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে—তখনই বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ঘোষণা দিলো—নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মতে, এই সিদ্ধান্ত শুধু বৈষম্যমূলক নয়, বরং উদ্দেশ্যমূলকভাবে নতুন উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে রাখার কৌশল। অবশ্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গঠনের কথা বলছে সরকার, আয়োজন করেছে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন। ঠিক এ সময় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে—যা বিনিয়োগের পথকে করে তুলেছে আরও কঠিন, বৈষম্যমূলক এবং অনিশ্চয়তায় ভরা।
তাই সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্ন উঠছে—এই বৈষম্য আসলে কার স্বার্থ রক্ষা করছে?
একই গ্যাস দুই দাম
১৩ এপ্রিলের পর গ্যাস-সংযোগ পাওয়া শিল্পগুলোকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসে ১০ টাকা বেশি করে গুনতে হবে ৪০ টাকা। নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের (ক্যাপটিভ পাওয়ার) জন্য গ্যাসের দাম বেড়ে হয়েছে ৪২ টাকা, যা আগে ছিল ৩১ টাকা ৫০ পয়সা।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে নতুন উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হবেন বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক ও বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘সরকার মূলত ভর্তুকি হ্রাসের মাধ্যমে রাজস্ব খাতে চাপ কমাতেই নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। এটি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে নেওয়া সিদ্ধান্ত হলেও এর প্রত্যক্ষ আর্থিক ও মানসিক প্রভাব পড়বে নতুন উদ্যোক্তাদের ওপর।’
রুবেল জানান, উদ্যোক্তারা বিশেষ করে যারা নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে চাচ্ছেন, তারা এ সিদ্ধান্তে দুশ্চিন্তায় পড়বেন। খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায় নামার আগেই অনেকেই পিছিয়ে যাবেন। পুরনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে নতুনদের জন্য। ফলে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হবে, যা উদ্যোক্তা বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তিনি আরও বলেন, ‘গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি যদি পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না থাকে, তাহলে দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যাবে।’
তার মতে, মূল্যবৃদ্ধির বদলে গ্যাসের অপচয় এবং ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা দূর করাই জরুরি ছিল। তিনি বলেন, ‘যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও অপচয় রোধ করলে দেশের সম্পদ ও অর্থ দুই-ই সাশ্রয় করা যেতো।’
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘পুরনোরা কোনোভাবে চাপ নিতে পারে, কিন্তু নতুনদের জন্য এটা একতরফা বোঝা। এতে নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে।’
বিনিয়োগ ও ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধিতে ধস
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ২১ কোটি ৩০ লাখ ডলার, গত বছরের তুলনায় তা প্রায় ৭০ শতাংশ কম। বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ফেব্রুয়ারিতে নেমেছে মাত্র ৬.৮২ শতাংশে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
শিল্পে যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নতুন প্রকল্পে ঋণ অনুমোদন দিচ্ছে না, এমনকি পুরনো অনুমোদনও স্থগিত করছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
অপচয়, অদক্ষতা আর দায় চাপানো হলো নতুনদের ওপর?
গ্যাসের দাম বাড়ানোর পেছনে যুক্তি হিসেবে আমদানির খরচ দেখালেও বাস্তবতা হলো— সরকার নিজেই স্বীকার করছে যে কারিগরি ক্ষতির নামে অপচয় হচ্ছে হাজার কোটি টাকার গ্যাস। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই অপচয় হয়েছে ১৩৭ কোটি ঘনমিটার গ্যাস, যার বাজার মূল্য প্রায় ১০ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।
প্রশ্ন উঠেছে, এই অপচয় ও অদক্ষতার দায় কেন নতুন উদ্যোক্তাদের কাঁধে চাপানো হলো?
ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, ‘সরকার নিজের অদক্ষতা ঢাকতে বৈষম্যমূলক দাম নির্ধারণ করছে। এক পণ্যে দুই দাম—এটা মুক্তবাজার নয়, এটা অনৈতিক প্রতিযোগিতা। এতে বিনিয়োগে ভয় ঢুকে যাচ্ছে।’
ফিকি‘র উদ্বেগ: বিদেশি বিনিয়োগে বড় ধাক্কা
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) এক বিবৃতিতে জানায়—‘একই শিল্প খাতে পৃথক গ্যাস মূল্য বৈষম্য তৈরি করবে। এটি শুধু উৎপাদন খরচে বৈষম্য নয়, বরং এটি বিনিয়োগকারীদের অনিশ্চয়তায় ফেলবে।’
সংগঠনটির সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, ‘স্বচ্ছ ও সংগতিপূর্ণ জ্বালানি মূল্য কাঠামো ছাড়া টেকসই শিল্প প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়।’ মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘বিইআরসির ঘোষণায় বিদ্যমান, নতুন ও প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের জন্য পৃথক গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা একই খাতে কার্যরত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বৈষম্য তৈরি করবে এবং ন্যায্য প্রতিযোগিতার পরিবেশকে ব্যাহত করবে।’
ফিকি জানায়, ‘সরকার টেকসই ও নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে যে লক্ষ্যে কাজ করছে, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে নতুন এই মূল্য কাঠামো ভবিষ্যতের বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে এবং সরকারের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।’
কারা লাভবান হবেন?
বিশ্লেষকদের মতে, গ্যাস আমদানিনির্ভর নীতিতে লাভবান হয়েছে আমদানিনির্ভর ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং সংশ্লিষ্ট লবির গ্যাস কোম্পানিগুলো। দেশে উৎপাদনের বদলে এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে এই গোষ্ঠীই এখন সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করছে।
বিশ্লেষকদের ভাষ্য, ‘যে নীতিতে পুরনো গোষ্ঠী সুরক্ষা পায়, নতুন উদ্যোক্তারা কোণঠাসা হয়— সে নীতি অবশেষে দেশীয় উৎপাদন, প্রতিযোগিতা এবং কর্মসংস্থান—সব কিছুর জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।’
গ্যাসের দাম বাড়ানোর পেছনের কাহিনি
২০২৩ সালে শিল্প খাতে গ্যাসের দাম এক ধাপে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল আমদানি করা গ্যাসের বিপরীতে মূল্য সমন্বয় করা হচ্ছে। কিন্তু সরবরাহ বাড়েনি আশানুরূপভাবে। এবার অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে দাম বাড়িয়েছে। প্রতি ঘনমিটারে নতুন শিল্পের জন্য দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ টাকা, আর ক্যাপটিভ পাওয়ার (নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাস) খাতে দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ টাকা।
বিশ্লেষকদের মতে, দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, একইসঙ্গে সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে—‘কারিগরি ক্ষতির’ নামে বিপুল পরিমাণ গ্যাস অপচয় হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই অপচয় হয়েছে ১৩৭ কোটি ঘনমিটার গ্যাস। এতে ক্ষতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।