বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত করোনার ভ্যাকসিন কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড (বেক্সিমকো ফার্মা)। বুধবার (১৯ মার্চ) বেক্সিমকো ফার্মার পক্ষ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একথা জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে সই করেছেন প্রতিষ্ঠানটির চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর রেজা।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ১৭ ও ১৮ মার্চ বিভিন্ন সংবাদপত্র, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টেলিভিশন চ্যানেলে প্রকাশিত বিভ্রান্তিকর ও মানহানিকর প্রতিবেদনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে বেক্সিমকো ফার্মা। এসব প্রতিবেদনে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ক্রয়ে দুর্নীতির সঙ্গে কোম্পানির সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলা হয়েছে। বেক্সিমকো ফার্মা এই ভিত্তিহীন অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে এবং অতিরঞ্জিত ও মানহানিকর শিরোনামের তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
প্রতিষ্ঠানটি জানায়, এসব সংবাদ একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ওষুধ উৎপাদন ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোম্পানির সুনাম ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি হাজারো সম্মানিত শেয়ারহোল্ডারকে ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করেছে। উল্লেখ্য, বেক্সিমকো ফার্মাতে ৩২ শতাংশেরও বেশি শেয়ার বিদেশি মালিকানাধীন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বেক্সিমকো ফার্মা বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট (এসএসআই) থেকে ১ দশমিক ৫ কোটি (১৫ মিলিয়ন) অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন (কোভিশিল্ড) ডোজ ক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যার মোট ব্যয় ছিল ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪৮০ কোটি টাকা)। এই সরবরাহের জন্য বেক্সিমকো ফার্মা প্রতি ডোজ ১ মার্কিন ডলার হিসাবে মোট ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১২০ কোটি টাকা) সার্ভিস ফি হিসাবে পেয়েছিল। ফলে ১৫ মিলিয়ন কোভিশিল্ড ডোজের মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৬০০ কোটি টাকা। তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও নিউজ পোর্টাল বিভ্রান্তিকরভাবে শিরোনাম প্রকাশ করে বেক্সিমকো ফার্মাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে বলে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, যেখানে বলা হয়েছে যে কোম্পানিটি কোভিড ভ্যাকসিন ক্রয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২২ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্তের আওতায় রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, প্রতিবেদনগুলোতে দাবি করা হয়েছে—দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় ২২ হাজার কোটি টাকা সরকারি তহবিল আত্মসাতের অভিযোগে সালমান এফ রহমান, বেক্সিমকো ফার্মা ও আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া, প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে—সরকার প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ও আলোচনার প্রক্রিয়া এড়িয়ে শুধু একটি উৎসের মাধ্যমে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করেছে।
এ প্রসঙ্গে কোম্পানির বক্তব্য হচ্ছে—কোভিড-১৯ মহামারির সময় ধনী দেশগুলো প্রায় সব ভ্যাকসিন ডোজ আগেই প্রি-বুক করে রেখেছিল। ফলে বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো মারাত্মক অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেও বৈশ্বিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল ছিল। তাই কোনও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানই ভ্যাকসিন সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে পারছিল না।
পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে বেক্সিমকো ফার্মা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রস্তুতকৃত অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনকে অগ্রাধিকার দেয়। এটি তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়বহুল ছিল, পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে ভালো ফলাফল দেখিয়েছিল এবং ফাইজার বা মডার্নার মতো আল্ট্রা-কোল্ড স্টোরেজের প্রয়োজন ছিল না।
বেক্সিমকো ফার্মা বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও কোভিশিল্ডের অনুমোদিত প্রস্তুতকারী ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের (এসএসআই) সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। ২০২০ সালের আগস্টে বেক্সিমকো ফার্মা ও সিরাম ইনস্টিটিউট কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন বিষয়ে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়, যেখানে বাংলাদেশের চাহিদা পূরণের জন্য সিরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃক বেক্সিমকো ফার্মা বাংলাদেশে একমাত্র পরিবেশক হিসেবে মনোনীত হয়।
বেক্সিমকো ফার্মার নিরলস প্রচেষ্টার ফলে অবশেষে বাংলাদেশ ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি কোভিশিল্ডের প্রথম চালান হিসেবে ৫০ লাখ ডোজ পায়। ফলশ্রুতিতে অনেক উন্নত দেশের আগেই বাংলাদেশ ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ থেকে দেশব্যাপী গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু করে। বেক্সিমকো ফার্মার পেশাদারত্ব, আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং নিরলস প্রচেষ্টার ফলে এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, প্রতিবেদনগুলোতে আরও দাবি করা হয়েছে যে সরকার, বেক্সিমকো ফার্মা ও ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট (এসএসআই)-এর মধ্যে ভ্যাকসিন ক্রয় চুক্তিতে সরকারি ক্রয়বিধি অনুসরণ করা হয়নি। কোনও যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বেক্সিমকো ফার্মাকে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় উচ্চ মূল্যে ভ্যাকসিন কিনতে বাধ্য হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কোম্পানির বক্তব্য হচ্ছে—সিরাম ইনস্টিটিউট (এসএসআই) সরাসরি সরকারের সঙ্গে চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ প্রতিষ্ঠানটি নিজেরা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে সক্ষম ছিল না এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল।
এছাড়া, সরকার সাধারণত বিদেশি প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে সরাসরি ভ্যাকসিন ক্রয় করে না। এ ধরনের চাহিদা পূরণ করতে সবসময় একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার মাধ্যমে ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।
বেক্সিমকো ফার্মা একটি দায়িত্বশীল মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে ভ্যাকসিনের সঠিকভাবে প্রাপ্তি সরবরাহ ও বিতরণ নিশ্চিত করেছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে যে যদি সরকার সরাসরি ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে ভ্যাকসিন ক্রয় করতো, তাহলে প্রতি ডোজে সাশ্রয় হওয়া অর্থ দিয়ে অতিরিক্ত ৬৮ লাখ ডোজ সংগ্রহ করা সম্ভব হতো।
এ প্রসঙ্গে কোম্পানির বক্তব্য হচ্ছে, ভ্যাকসিন ক্রয় চুক্তি (https://beximco-pharma.com/cdn/bpl/bdesh-signed-purchase-agreementdt.18.12.2020.pdf-এ দেখা যাবে) ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে ভ্যাকসিনের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি ডোজ ৪ মার্কিন ডলার। চুক্তিতে একটি বিশেষ শর্ত ছিল, যদি সিরাম ইনস্টিটিউট ভারতে কম মূল্যে ভ্যাকসিন বিক্রি করে, তাহলে বাংলাদেশও সেই কম মূল্যে পরিশোধ করবে। তবে, যদি ভারতের মূল্য বেশি হয়, তাহলেও বাংলাদেশকে প্রতি ডোজ ৪ ডলারই পরিশোধ করতে হবে। সরবরাহ চুক্তি অনুযায়ী মোট ৩ কোটি ডোজের ব্যবস্থা করা হলেও সিরাম ইনস্টিটিউট শেষ পর্যন্ত দেড় কোটি (১৫ মিলিয়ন) ডোজ সরবরাহ করে, যার মোট মূল্য দাঁড়ায় ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪৮০ কোটি টাকা)।
প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বেক্সিমকো ফার্মা ১৫ মিলিয়ন ডোজ সরবরাহের জন্য প্রতি ডোজে ১ ডলার হিসাবে মোট ১৫ মিলিয়ন ডলার (১২০ কোটি টাকা) পেয়েছে। ফলে, ১৫ মিলিয়ন কোভিশিল্ড ডোজের জন্য মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। অথচ কিছু সংবাদমাধ্যম ও নিউজ পোর্টাল ভুল ও বিভ্রান্তিকর শিরোনাম দিয়ে বেক্সিমকো ফার্মাকে ২২ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্তের সঙ্গে জড়িয়ে অপপ্রচার করছে।
প্রতি ডোজ ১ মার্কিন ডলার সার্ভিস ফি বেক্সিমকো ফার্মাকে প্রদান করা হয়েছিল—যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল সব নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা, ভ্যাকসিন আমদানি, সংরক্ষণ এবং দেশব্যাপী বিতরণ, যেখানে প্রতিটি ধাপে কোল্ড চেইন কঠোরভাবে নিশ্চিত করা হয়। এছাড়া, পরিবহনের সময় ঝুঁকি কভারেজও অন্তর্ভুক্ত ছিল (যেমন- দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি, সংরক্ষণকালে তাপমাত্রার তারতম্য ইত্যাদি)। এই কার্যক্রমে বেক্সিমকো ফার্মা বিমা কাভারেজ না পাওয়াতে পূর্ণ আর্থিক দায়ভারও গ্রহণ করেছিল। এই সার্ভিস ফি স্থানীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার (আমদানিকৃত ওষুধের জন্য প্রযোজ্য নীতিমালা অনুসরণ করে নির্ধারিত হয়েছিল। প্রতি ডোজ ৫ মার্কিন ডলার বা ৪০০ টাকা।) মোট খরচে, এটি ছিল বাংলাদেশ সরকার দ্বারা কোনও কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের জন্য পরিশোধিত সর্বনিম্ন মূল্য। চুক্তির শর্তাবলি ছাড়াও, বেক্সিমকো ফার্মা সরকারকে অতিরিক্ত ৩২ মিলিয়ন (৩ কোটি ২০ লাখ) ডোজ ফাইজার, মডার্না, সিনোফার্ম, সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন সংরক্ষণ এবং বিতরণে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সহায়তা করেছে।
মহামারিতে দেশের জন্য অসামান্য ভূমিকা পালনের জন্য বেক্সিমকো ফার্মা ২০২০ সালে অত্যন্ত সম্মানজনক সিপিএইচএল ফার্মা অ্যাওয়ার্ডস-এ ‘ইনোভেশন ইন রেসপন্স টু কোভিড-১৯’ ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হয়েছে, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ফার্মা কোম্পানির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। যদিও এই অসাধারণ অর্জন বাংলাদেশ এবং তার ফার্মা সেক্টরকে, বিশেষ করে বৈশ্বিক মানবিক সংকটে তার ইতিবাচক ভূমিকার জন্য বিশ্বব্যাপী সম্মানিত করেছে। এটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক যে এখন বেক্সিমকো ফার্মাকে নিজ দেশের মিডিয়া ট্রায়ালের লক্ষ্যে পরিণত হতে হচ্ছে।
বেক্সিমকো ফার্মা দৃঢ়ভাবে দাবি করছে যে এটি সব লেনদেন প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সম্পন্ন করেছে। লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানি হিসেবে বেক্সিমকো ফার্মা তার অপারেশনাল এবং আর্থিক প্রকাশনায় পূর্ণ স্বচ্ছতা রক্ষা করে। কোম্পানিটি কখনও কোনও ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়নি বরং এটি দেশের সবচেয়ে বড় ওষুধ রফতানিকারক হিসেবে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এবং ৬০টিরও বেশি দেশে তার বৈশ্বিক উপস্থিতি রয়েছে। এর পাশাপাশি বেক্সিমকো ফার্মা রেকর্ড সর্বোচ্চ নয়বার জাতীয় রফতানি স্বর্ণপদক জয়লাভ করেছে।
মিডিয়ায় প্রকাশিত অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বিকৃত এবং একটি কাল্পনিক অপপ্রচার অভিযানের অংশ। বেক্সিমকো ফার্মা এমন মানহানিকর রিপোর্টিংয়ের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার সংরক্ষণ করে। কারণ এটি আমাদের সুনামকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমরা মিডিয়াকে পেশাগত দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন এবং সংবাদ প্রকাশের আগে তথ্য যাচাই করার আহ্বান জানাচ্ছি। বেক্সিমকো ফার্মা স্বচ্ছতা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং প্রয়োজন হলে যেকোনও তথ্য প্রদান করতে সবসময় প্রস্তুত।
