রাজধানীর পাড়া-মহল্লার নির্দিষ্ট কোনায় কোনায় নিম্নবিত্ত মানুষের জটলা। কিছু পুরুষ আবার কিছু নারী। বেশির ভাগ নারী আসেন মুখে মাস্ক পরে, বোরকা গায়ে। যা অনেকটাই মুখ লুকানোর একটা চেষ্টা, বোঝা যায় স্পষ্ট। এখানে আসা মানুষের মধ্যে কেউ গল্প করছেন, কেউ বা বুকের সন্তানকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছেন, আবার কেউ পাশে রাখা ভ্যানের ওপর সন্তানকে শুইয়ে দিয়ে সামনের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। কখন আসবে টিসিবির ট্রাক, সেই অপেক্ষা। সকাল ৬টার পর থেকে কখনও কখনও ১১-১২টা পর্যন্ত মানুষের এমন জটলা দেখা যায় রাজধানীর প্রধান সড়কে। যদিও টিসিবির ট্রাক আসার নির্দিষ্ট কোনও সময় নেই। কোনও দিন আসে, আবার কোনও দিন আসেও না। তাই তো এই অপেক্ষা। জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে প্রতিদিন সড়কের নির্দিষ্ট স্থানে জমে এসব গরিব মানুষের ভিড়। প্রতিনিয়তই এসব মানুষের অপেক্ষা ও লাইন ক্রমাগত দীর্ঘ হচ্ছে। কখন আসবে টিসিবির ট্রাক। কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায় বলেই রাজধানীর নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে মানুষের এই অপেক্ষা।
এদিকে টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, ট্রাকের লাইনে দাঁড়ানো একজন ভোক্তা সর্বোচ্চ দুই লিটার সয়াবিন তেল বা রাইসব্রান তেল, দুই কেজি মসুর ডাল, এক কেজি চিনি, দুই কেজি ছোলা ও ৫০০ গ্রাম খেজুর কিনতে পারেন। প্রতি লিটার ভোজ্যতেল ১০০ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডাল ৬০ টাকা, প্রতিকেজি চিনি ৭০ টাকা, প্রতিকেজি ছোলা ৬০ টাকা ও ১৫৬ টাকা কেজি দরে ৫০০ গ্রাম খেজুর ৭৮ টাকায় বিক্রি করা হয়। বিদ্যমান বাজার মূল্যের তুলনায় টিসিবি থেকে এসব পণ্য কিনে প্রায় ৪০০ টাকা সাশ্রয় করতে পারেন ক্রেতারা। তাই টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে প্রতিদিন লাইনে জায়গা পেতে অপেক্ষা করেন রাজধানীর নিম্ন আয়ের মানুষেরা। রাজধানীর কয়েকটি স্পট ঘুরে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, পণ্য বিক্রির আওতা বাড়িয়েছে টিসিবি। কিন্তু ট্রাকপ্রতি পণ্যের বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এতদিন টিসিবির একটি ট্রাকে ২৫০ জনের পণ্য বিক্রি করা হতো। তবে গত তিন দিন ধরে প্রতিটি ট্রাকে ২০০ জনের জন্য পণ্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আগে ঢাকায় ৫০ ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে পারতেন সাড়ে ১২ হাজার মানুষ। এখন সেটি কমে ১০ হাজারে নেমেছে। অর্থাৎ শুধু ঢাকাতেই আড়াই হাজার মানুষের বরাদ্দ কমিয়েছে টিসিবি। একইভাবে চট্টগ্রামেও বরাদ্দ কমেছে এক হাজার মানুষের।
বরাদ্দ কমানোর বিষয়ে টিসিবি জানিয়েছে, দেশের আরও কয়েকটি বিভাগীয় শহরে টিসিবির এই কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে ট্রাকপ্রতি বরাদ্দ কিছুটা কমানো হয়েছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, এমনিতেই টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে না পেরে প্রতিদিন অনেক মানুষ খালি হাতে ফিরছেন। বরাদ্দ কমে যাওয়ায় এই সংখ্যা আরও বেড়েছে।
জানা গেছে, দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে টিসিবির পণ্য ক্রয়ের জন্য দরিদ্র এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও ট্রাকের লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। বাজার থেকে সয়াবিন তেল, ডাল, চিনি, ছোলা ও খেজুর না কিনে টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াচ্ছেন দেশের সাধারণ মানুষ। উদ্দেশ্য সাশ্রয়ী মূল্যে এসব পণ্য কিনে কিছু টাকা সাশ্রয় করা। কিন্তু এই লাইন ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। আগে পাড়ায় মহল্লায় এসব লাইন শুরু হতো সকাল ৮টার পরে, এখন মানুষ এই লাইনে দাঁড়ায় সকাল ৬টা থেকে। উদ্দেশ্য সাশ্রয়ী দামে এসব পণ্য কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এই উদ্দেশ্য সফল হচ্ছ না। লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য না পেয়ে খালি হতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে অনেককে। চাহিদার তুলনায় পণ্য কম থাকায় এ ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৫নং ওয়ার্ডের কোনাপাড়া এলাকার বাসিন্দা লোকমান হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিদিনই টিসিবির লাইনে পণ্য কেনার জন্য দাঁড়াই। কিন্তু ট্রাকের কাছাকাছি আসতেই শুনি পণ্য নেই। তাই খালি হতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।’
খিলক্ষেত বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো টিসিবির ডিলার মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারীর প্রতিনিধি তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিদিন ২০০ মানুষের মাল আনি। লাইনে দাঁড়ায় ৩০০ জন। স্বাভাবিক নিয়মেই প্রতিদিন এই এক স্পট থেকে ১০০ মানুষ ফিরে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নাই। অথচ প্রতিদিন এ নিয়ে মানুষের সঙ্গে আমাদের ঝগড়া-বিবাদ করতে হচ্ছে।’
টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ূন কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি কার্যক্রমে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। তবে এবার বাজার দরের সঙ্গে দাম সমন্বয়ের জন্য ডালের দাম ৫ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। সামনে ডালের দাম কমলে টিসিবি যেখান থেকে কিনে এনে বিক্রি করে সেখানে কম দামে পেলে আবারও দাম কমিয়ে বিক্রি করা হবে।’
তিনি জানান, ভবিষ্যতে টিসিবির কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত করা হবে। তখন বেশি মানুষ উপকৃত হবেন।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে হুমায়ূর কবির বলেন, ‘দেশের আরও কয়েকটি বিভাগীয় শহরে টিসিবির এই কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে ট্রাকপ্রতি বরাদ্দ কিছুটা কমানো হয়েছে।’
জানা গেছে, টিসিবির পণ্য বিক্রি কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য হলো, স্বল্প আয়ের মানুষকে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য বিক্রি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। তবে টিসিবির পণ্য বিক্রি কার্যক্রমের যে চিত্র রাজধানীতে দেখা গেছে তা অত্যন্ত হতাশাজনক। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেক মানুষ পণ্য কিনতে পারছেন না। ট্রাক আসার পর পণ্য কেনার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে যায়। দুর্বল ও বয়স্ক ব্যক্তিরা এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পণ্য কিনতে ব্যর্থ হন। টিসিবির ট্রাক কখন আসবে জানেন না কেউ, তারপরও রোজা রেখে শত শত মানুষ সকাল থেকে রাস্তার ধারে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা।
টিসিবি সংশ্লিষ্ট ডিলাররা জানিয়েছেন, রাজধানীর ৫০টি স্থানে পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। এর মধ্যে কালশী, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী ও রামপুরায় সাধারণ মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়ে মারধরেরও শিকার হয়েছেন ট্রাকের কর্মীরা। কালশীতে এক ট্রাকচালককে মেরে রক্তাক্ত করার ঘটনাও ঘটেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জানান, প্রতিটি ট্রাকে বরাদ্দ করা পণ্যের তুলনায় ক্রেতার সংখ্যা অনেক বেশি। এ কারণে বিশৃঙ্খলা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে টিসিবির পণ্যের সরবরাহ ও ট্রাকের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি। যদিও টিসিবির সক্ষমতা রাতারাতি বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও বিবেচনায় রাখতে হবে। সরকারকে বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে কঠোর দৃষ্টি দিতে হবে। বাজারের সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। তাহলে সাধারণ মানুষ নিত্যপণ্য ক্রয় করতে পারবে। এতে টিসিবির পণ্য ক্রয়েও এর প্রভাব পড়বে।