দেশের চলমান বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে ধস নেমেছে। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারিতে এডিপি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৮৭৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, আর গত সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে ৫৯ হাজার ৮৭৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকার। বাস্তবায়ন হার মাত্র ২১ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে অতিমূল্যায়িত এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্পগুলোর পুনর্মূল্যায়ন চলছে। এতে অনেক প্রকল্প বাতিল হয়েছে এবং অনেক প্রকল্পের বাজেট সংকোচন করা হয়েছে, যার ফলে এডিপি বাস্তবায়ন সংকটের মুখে পড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থছাড় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলোর যথার্থতা ও প্রয়োজনীয়তা যাচাই করা হচ্ছে, যাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় পরিহার করা যায়।
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতি হয়েছে ৫৯ হাজার ৮৭৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকার। শতাংশের হিসাবে বাস্তবায়ন হয়েছে ২১ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছিল ৭৪ হাজার ৪৬৪ কোটি ১৯ লাখ টাকার। সে বছর বাস্তবায়ন হার ছিল ২৭ দশমিক ১১ শতাংশ। আইএমইডির তথ্য বলছে, এর আগে কোনো অর্থবছরের সাত মাসে এত কম এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য নেই।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুধু জানুয়ারিতে এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে ৯ হাজার ৮৭৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকার; যা একক মাস হিসেবে বাস্তবায়ন হার ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর বছরের একই সময় যা ছিল ১২ হাজার ৭২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সে বছর বাস্তবায়ন হার ছিল ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
কমিশন সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের এডিপি থেকে ৪৯ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট হচ্ছে। এর মধ্যে সরকারের অংশ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ও বৈদেশিক বরাদ্দ থেকে ১৯ হাজার কোটি টাকা। এর আগে কোনো অর্থবছরে এত বেশি পরিমাণ অর্থ এডিপি থেকে কাটছাঁট করা হয়নি। শুধু সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ থেকেই ১১ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা কাটছাঁটের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের এডিপির আকার ধরা হয় ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রাজনৈতিক বা প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলো পুনরায় বিবেচনা করা উচিত। কারণ, সরকার আর্থিক সংকটে আছে, রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি রয়েছে। সরকারকে ব্যয় কমাতে হবে। ব্যয় কমানোর বড় জায়গা এডিপি। প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় বরাদ্দ দিতে হবে। কারণ, এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন অনেক এগিয়েছে। যেসব মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো, সেগুলো শেষ করা ভালো হবে। তবে যেসব মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি বা প্রাথমিক ধাপে আছে, সেগুলো বাদ দেওয়া ভালো হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাস্তবায়নের গতি কম থাকায় সরকারি তহবিলের চাহিদাও অনেক কমেছে। সাধারণত অন্যান্য অর্থবছরের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সরকারি তহবিল থেকে চাহিদা অনেক বেশি থাকে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে এডিপিতে যে পরিমাণ সিলিং বেঁধে দেওয়া হয়েছে, চাহিদা তার চেয়ে কম রয়েছে। তবে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে চলতি অর্থবছরে চাহিদার চেয়ে বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে ৭০-৭৫ হাজার কোটি টাকা চাহিদা দিয়েছিল। কিন্তু সরকার বৈদেশিক অর্থায়ন ব্যবহারের গুরুত্ব দেওয়ায় বরাদ্দ বাড়িয়ে ৮১ হাজার কোটি টাকার সিলিং দেওয়া হয়।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে সবচেয়ে বেশি ১১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ১১ হাজার ২৫১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এরপর সর্বোচ্চ ব্যয় করেছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ, ৫ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন করেছে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ, মাত্র ১৯ কোটি টাকা আর ৫৭৪ কোটি টাকা।