শ্রমিক অসন্তোষ ও বিভিন্ন কারণে গভীর সংকটের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিল রফতানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাত। সরকার পরিবর্তনের পর টানা প্রায় চার মাস অস্থিরতা বিরাজ করে এই খাতে। আস্থার সংকট দেখা দেয় বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে। ক্রেতাদের আস্থা ফেরাতে সরকারের পাশাপাশি তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত ছয় মাসে বন্ধ হয়েছে তৈরি পোশাক খাতে ১০০টির বেশি কারখানা। এর মধ্যে ৮৩টি কোম্পানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আরও অন্তত ১০টি অস্থায়ী ভিত্তিতে বন্ধ হয়েছে। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এসব কারখানা বন্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। অবশ্য রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, গত ছয় মাসে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হলেও রফতানি আয় কমেনি, বরং গত কয়েক মাস ধরে পোশাক রফতানি আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। শুধু তাই নয়, রফতানি বাড়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন গার্মেন্টস খাতের উদ্যোক্তারাও। তারা বলছেন, শ্রম অসন্তোষে ও ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হলেও অবিশ্বাস্যভাবে রফতানি আয় বাড়ছে।
একই সঙ্গে তারা বলছেন করেছেন, তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে আস্থার সংকট দানা বেঁধেছিল তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। আর অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই রফতানি প্রবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিতে বেশ খানিকটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। কারণ সম্প্রতি মার্কিন ডলার সংকটসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশে অর্থনীতি।
প্রসঙ্গত, তৈরি পোশাক রফতানিতে ঈর্ষণীয় এই প্রবৃদ্ধির বেশিরভাগ সময়েই অস্থিরতা ছিল পোশাক খাতে। দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক খাতে শ্রম অসন্তোষ শুরু হয় সরকার পরিবর্তনের পরপরই। আশুলিয়া, গাজীপুর, সাভার শিল্পাঞ্চলের শ্রম অসন্তোষ চলতে থাকে গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। সদ্য বিদায়ী জানুয়ারি মাসেও অস্থিরতার প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। জানা গেছে, এখনও ভেতরে ভেতরে অন্তত ৩ থেকে ৫ শতাংশ পোশাক কারখানায় শ্রম অসন্তোষ চলছে। ইনক্রিমেন্ট (বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি) নিয়ে জটিলতা চলছে অন্তত ৯ শতাংশ পোশাক কারখানায়।
যদিও এই পরিস্থিতির মধ্যে টানা ৫ মাসই রফতানি আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গার্মেন্ট খাতের এই পরিস্থিতির মধ্যে রফতানি আয়ের উল্লম্ফনে অনেকে প্রশ্ন তুললেও কারখানার মালিকরা বলছেন অন্তত গুরুত্বপূর্ণ ৬টি কারণে রফতানি আয় বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বেশ কয়েকটি কারণে রফতানি আয় বেড়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, কর্মীদের দক্ষতা বেড়েছে। শ্রমিকরা আগের তুলনায় দক্ষ হওয়ার কারণে চালু থাকা বেশিরভাগ কারখানার উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। ব্যাংকের অসহযোগিতাসহ বেশ কিছু কারণে অনেক ছোট বা মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও বড় ও দক্ষ কারখানাগুলো উৎপাদন বাড়িয়েছে। ফলে মোট রফতানি আয় কমেনি, বরং কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে।
সংকটের মধ্যেও যেসব কারণে রফতানি আয় বেড়েছে
ডলারের দর বৃদ্ধি
টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় রফতানিকারকরা বেশি টাকার সমপরিমাণ রফতানি আয় পাচ্ছেন, যা মোট রফতানি বৃদ্ধির একটি কারণ হতে পারে।
বড় কারখানাগুলোর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি
অনেক ছোট বা মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও বড় ও দক্ষ কারখানাগুলো উৎপাদন বাড়িয়েছে। ফলে মোট রফতানি আয় কমেনি, বরং কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে।
উচ্চমূল্যের পণ্য রফতানি
বাংলাদেশ এখন আগের তুলনায় বেশি মূল্য সংযোজিত (ভেল্যু অ্যাডেড) ও প্রিমিয়াম মানের পোশাক তৈরি করছে, যা প্রতি ইউনিটে বেশি দামে বিক্রি হয়।
অর্ডারের একক সংযোজন
বড় ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা সাধারণত নির্ভরযোগ্য এবং টেকসই কারখানাগুলোর দিকে ঝুঁকছেন, যেখানে এককভাবে বেশি অর্ডার দেওয়া হচ্ছে। ফলে কিছু কারখানা বন্ধ হলেও বাকিগুলোতে উৎপাদন বাড়ছে।
পণ্য পাঠানোর দেরি ও পুরনো অর্ডারের ডেলিভারি
অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক সরবরাহ সংকটের কারণে কিছু পুরনো অর্ডার দেরিতে পাঠানো হয়েছে, যা এখন রফতানি পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।
বিকল্প উৎস থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ
বাংলাদেশ কিছু নির্দিষ্ট দেশে তুলা ও কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু বিকল্প বাজার থেকে কাঁচামাল আমদানি করায় উৎপাদন ব্যাহত হয়নি।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। আর একক মাসের হিসাবে ডিসেম্বরে রফতানির হার আরও বেশি। মাসটিতে বেড়েছে ১৮ শতাংশ। আগের মাস নভেম্বরে পোশাক খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে ওভেন পোশাক রফতানি বেড়েছে ২০ শতাংশ।
ইপিবির হিসাবে নভেম্বর মাসে তৈরি পোশাক রফতানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩০ কোটি ৬১ লাখ ডলারে— যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৮৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
আর অক্টোবর মাসে তৈরি পোশাক খাত ৩ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।
এদিকে রফতানি আয় বৃদ্ধিতে খুশি হতে পারছেন না এই খাতের উদ্যোক্তারা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সার্বিকভাবে রফতানি আয় বাড়লেও পোশাকের ব্যবসায় তাদের মুনাফা বা আয় বাড়েনি। উল্টো তাদের খরচ বেড়েছে। বায়ারদের লিডটাইম পূরণে অনেক মালিককে সাম্প্রতিককালে বাধ্য হয়ে অর্ডারের পোশাক এয়ার ফ্রেইটের মাধ্যমে নিজস্ব খরচে পাঠাতে হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকে। খেলাপি ঋণ নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করায় অনেক কারখানা খেলাপি হয়ে পড়ে। আবার ক্ষমতাচ্যুত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ অনেক কারখানার মালিক আত্মগোপনে থাকায় কারখানা রুগ্ন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না কিছু কারখানা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রফতানি বাড়লেও এই খাতের উদ্যোক্তাদের চাপ কমেনি।’ তিনি জানান, ‘সুতার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। অর্থাৎ, উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
জানা গেছে, বন্ধ হওয়া কারখানার মধ্যে অন্তত ৫১টি গাজীপুরে এবং সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে বন্ধ হয়েছে আরও ১৭টি। এসব কারখানায় কাজ করতেন অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিএমইএ’র একজন সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে সেসব কারখানার বেশিরভাগ শ্রমিক এরইমধ্যে চালু থাকা কারখানায় কাজ পেয়েছে। তিনি বলেন, সংখ্যার দিক থেকে বেশি বন্ধ হচ্ছে ছোট ছোট কারখানা। পক্ষান্তরে বড় আকারের কারখানা উৎপাদন বাড়াচ্ছে। তার মতে, ছোট কারখানা যদি ২০টি বন্ধ হয়, যেখানে যদি ২০ হাজার কর্মী থাকে। বন্ধ হওয়া কারখানার শ্রমিকরা চালু থাকা ১০টি বড় কারখানায় কাজ পেয়েছে।
আরেকটি একটি সূত্র বলছে, সম্প্রতি ছোট ও মাঝারি আকারের কারখানা বন্ধ হলেও বিগত কয়েক বছরে পরিবেশবান্ধব ও সবুজ কারখানা চালু হয়েছে বেশি। সেই সূত্রের দাবি, গত ছয় মাসে যে পরিমাণ কারখানা বন্ধ হয়েছে, সবুজ কারখানায় উৎপাদন বেড়েছে তার চেয়ে বেশি।
উল্লেখ্য, ১৫/২০ বছর আগে ছোট ছোট কারখানা গড়ে তোলা হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বড় বড় কারখানা স্থাপন করছেন।
গাজীপুর নগরের জরুন এলাকার কেয়া গ্রুপ দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছে। ২ জানুয়ারি কর্তৃপক্ষ এক নোটিশে জানায়, আগামী ১ মে থেকে চারটি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হবে।
কেয়া গ্রুপের নোটিশে বলা হয়, বর্তমান বাজার অস্থিতিশীলতা, ব্যাংকের সঙ্গে হিসাবের অমিল, কাঁচামালের অপর্যাপ্ততা ও কারখানার উৎপাদন কার্যক্রমের অপ্রতুলতার জন্য তাদের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র কারখানাগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শ্রম আইন অনুযায়ী সব পাওনা কারখানা বন্ধের পরের ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে পরিশোধ করা হবে।
স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বন্ধ তৈরি পোশাক কারখানার মধ্যে রয়েছে গাজীপুর মহানগরীর সারাব এলাকার বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬টি, টঙ্গীর সাতাইশ এলাকার টিএমএস অ্যাপারেলস, চন্দ্রা এলাকার নায়াগ্রা টেক্সটাইল, মাহমুদ জিনস ও হার্ডি টু এক্সেল, কোনাবাড়ীর পলিকন লিমিটেড, অ্যাপারেল প্লাস, টিআরজেড ও দি ডেল্টা নিট অন্যতম।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, সুদহার বৃদ্ধি, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
এর প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগে। নতুন করে বিনিয়োগের সাহস পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। এছাড়া ঊর্ধ্বমুখী সুদহারে নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন না হওয়ায় কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি।