Homeঅর্থনীতিউন্নয়ন ব্যয়ে ফের ধীরগতি

উন্নয়ন ব্যয়ে ফের ধীরগতি


চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের গতি আবারও শ্লথ হয়ে পড়েছে। তিন মাসের ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতির পর ফেব্রুয়ারিতে এডিপি বাস্তবায়নের ব্যয় ২ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা কমেছে, যা চলতি অর্থবছরের শেষ পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, একক মাসের পাশাপাশি অর্থবছরের প্রথম আট মাসেও এডিপি বাস্তবায়নের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এতে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এডিপি বাস্তবায়ন ব্যয় কমেছে ১৮ হাজার ৪৯ কোটি টাকা।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নতুন সরকারের নীতি পরিবর্তনের ফলে অনেক প্রকল্প স্থগিত বা পুনর্মূল্যায়নের আওতায় এসেছে। আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মোট বরাদ্দের ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩১ দশমিক ১৭ শতাংশ। এমনকি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম আট মাসেও যখন মহামারির প্রভাব ছিল সর্বোচ্চ, তখনো বাস্তবায়নের হার ছিল ৩৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অর্থাৎ এবারের বাস্তবায়নের হার গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও অর্থনৈতিক সংকট

গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর দেশে সরকার পরিবর্তন হয়। নতুন সরকার অতিমূল্যায়িত প্রকল্প এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোর পুনর্বিবেচনায় মনোযোগী হয়েছে। ফলে বেশ কিছু প্রকল্প বাতিল হয়েছে এবং অনেকের অর্থায়ন সংকুচিত হয়েছে। বিশেষ করে যেসব প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সমর্থন পেয়েছিল, সেগুলোকে নতুন করে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধীরগতির অন্যতম কারণ হচ্ছে রাজস্ব ঘাটতি ও বৈদেশিক ঋণনির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নের অনিশ্চয়তা। অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থবছরের প্রথম দিকে সাধারণত এডিপি বাস্তবায়ন ধীরগতিতে থাকে। তবে এবারের ধীরগতি ব্যতিক্রম; কারণ, এটি শুধু বছরের শুরুতেই নয়, মধ্যভাগেও অব্যাহত রয়েছে।

পরিসংখ্যান ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ

আইএমইডির প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে এডিপি বাস্তবায়নের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা, যা জানুয়ারির তুলনায় ২ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা কম। একক মাসের হিসাবে এটি গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

এডিপির বরাদ্দের অগ্রগতির হার ফেব্রুয়ারিতে ২.৬৭ শতাংশ, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪.০৬ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন কমেছে ৩ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম আট মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২১.১৩ শতাংশ, যেখানে বৈদেশিক সাহায্য অংশে বাস্তবায়ন ২৭.৪৭ শতাংশ। সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের হার ৩৯.৩১ শতাংশ।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন চিত্র

প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ। ৪ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে আট মাসে তারা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে মাত্র ২০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের মাত্র ০.৪১ শতাংশ।

জাতীয় সংসদ সচিবালয়ও এডিপি বাস্তবায়নে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। ১.২৫ কোটি টাকার বরাদ্দের বিপরীতে আট মাসে বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র ২.১৮ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগও পিছিয়ে রয়েছে; তারা ৭৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ২৮ কোটি টাকা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে, যা বরাদ্দের মাত্র ৩.৭২ শতাংশ। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ৫.৪৮ শতাংশ, ভূমি মন্ত্রণালয় ৬.৪১ শতাংশ এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ৬.৭৭ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে। এই ধীরগতির ফলে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেবা খাতের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

এডিপির সামগ্রিক চিত্র ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

চলতি অর্থবছরের জন্য এডিপির মোট বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, বৈদেশিক ঋণ এক লাখ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ১৩ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোটা ব্যবহার করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন গতি ফেরাতে হলে নীতিগত সংস্কার ও অর্থায়নে স্বচ্ছতা আনতে হবে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে অগ্রগতি মূল্যায়ন করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে ব্যয় পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালিত হতে পারে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে অর্থবছরের শেষ দিকে এসে বাজেট বাস্তবায়নের চাপ বাড়বে এবং অনেক প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ফেরত যেতে পারে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত