মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে টুপি ও আতর শুধু অপরিহার্য উপকরণ নয়, বরং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। বছরজুড়ে এগুলোর চাহিদা থাকলেও রমজান ও ঈদ এলে তা বহুগুণে বেড়ে যায়। বাংলাদেশে বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর কারণে এই সময় টুপি ও আতরের বাজারে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়।
চলতি বছরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পুরো রমজানে রমরমা ছিল রাজধানীর টুপি ও আতরের বাজার। তবে বিক্রেতাদের অভিজ্ঞতা ছিল মিশ্র। কেউ অভূতপূর্ব সাফল্যের কথা বলছেন, আবার কেউ আশানুরূপ বিক্রি না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন।
টুপির বাজার
দেশে টুপির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চকবাজার ও গুলিস্তানের খদ্দর মার্কেট। এ ছাড়াও পীর ইয়ামেনী মার্কেট, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ মার্কেটেও পাইকারি ও খুচরা টুপি বিক্রি হয়।
পীর ইয়ামেনী মার্কেটের ব্যবসায়ী মো. লিটন, যিনি ৩০ বছর ধরে টুপি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তিনি জানান, এবারের বিক্রি তাঁকে অত্যন্ত সন্তুষ্ট করেছে। তাঁর মতে, ‘২০২৫ সালের মতো টুপি বিক্রি আর কখনোই হয়নি।’ তিনি বলেন, বড় দোকানগুলো দিনে প্রায় ২০ লাখ টাকার টুপি বিক্রি করেছে। গুলিস্তানের বাজারে এ মৌসুমে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার টুপির বাণিজ্য হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শবে বরাতের আগে থেকেই কারখানাগুলোতে টুপি তৈরির কাজ শুরু হয়, যা চলে সাধারণত ২০ রোজা পর্যন্ত। এরপর খুচরা বাজারে টুপির বিক্রি তুঙ্গে ওঠে। রমজানের পাশাপাশি কোরবানির ঈদেও টুপির ব্যাপক চাহিদা থাকে। এ সময় সাধারণ মানুষ ছাড়াও হজযাত্রীরা নতুন টুপি কেনেন। এ ছাড়া বিশ্ব ইজতেমা এবং শীতকালীন মাহফিলগুলোতেও টুপির ভালো চাহিদা থাকে।
পাকিস্তানি টুপির চাহিদা বেশি
বাজারে দেশি, পাকিস্তানি, আফগানি—বিভিন্ন ধরনের টুপি পাওয়া যায়। তবে ক্রেতাদের মধ্যে পাকিস্তানি টুপির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। খুচরা বিক্রেতা আমির হোসেন সিয়াম জানান, পাকিস্তানি, দেশি, আফগানি সব টুপিই চলে, তবে পাকিস্তানির চাহিদা বেশি। দেশি টুপিও গুণগত মানে ভালো এবং বিদেশেও রপ্তানি হয়। আল কবির, আল আজিম, আল ফারুক, আল ফিরোজ, আল-রাহাদ ব্র্যান্ডের টুপির চাহিদা বেশি। বাজারে গোল টুপি, নেট টুপি, পাঁচ কল্লি টুপি ইত্যাদি নানা ধরনের পাওয়া যায়। দাম ৬০ থেকে শুরু করে ১ হাজার টাকার মধ্যে।
বিক্রেতারা জানিয়েছেন, চীন, তুরস্ক, পাকিস্তান, মিসর, থাইল্যান্ড, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইয়েমেন, লেবানন, মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশ থেকে টুপি আমদানি করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি টুপি আসে চীন থেকে। কম দাম ও দেখতে চকচকে হওয়ায় বাজারে চীনে তৈরি টুপির চাহিদা বেশি। তবে যাঁরা একটু ভালো মানের অভিজাত টুপি চান, তাঁরা তুরস্ক, পাকিস্তান ও মিসরের টুপি কেনেন।
বাংলাদেশ টুপি প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সভাপতি মো. ফারুক আহমেদ খান জানান, তাঁদের সমিতির অধীনেই সারা দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক টুপির কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর এলাকায় ৩০টির বেশি কারখানা আছে। এ ছাড়া কেরানীগঞ্জ, সাইনবোর্ড, মিরপুর, লালবাগ ও চকবাজারে বেশ কিছু কারখানা রয়েছে। ঢাকার বাইরে বগুড়া, রংপুর, পঞ্চগড়, নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও ফেনীসহ কয়েকটি জেলায় টুপি তৈরি করা হয়। এসব জেলায় হাতে তৈরি টুপি বেশি পাওয়া যায়। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশে তৈরি টুপির একটা বড় অংশ রপ্তানিও হয়।
আতরের বাজারও রমরমা
রমজানে আতরের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। দেশের বাজারে থাকা বেশির ভাগ আতর মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা হয়। খদ্দর বাজারের ব্যবসায়ী ফরিদ উদ্দিন জানান, প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার আতর বিক্রি হয়েছে। ক্রেতাদের মধ্যে আমির আল উদ, এহসাস আল আরব, ডানহিল ডিজার, জমজম ব্র্যান্ডের আতর জনপ্রিয়। উন্নতমানের আতরের দাম প্রতি ১০০ গ্রাম ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
জায়নামাজের বিক্রি তুলনামূলক কম
রমজানে জায়নামাজের বিক্রি বাড়লেও, এটি টুপি-আতরের মতো সমানতালে চলে না। কারণ, একটি জায়নামাজ দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়। তুরস্ক, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের জায়নামাজ বাজারে বেশি পাওয়া যায়; দাম ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে।