Homeসাহিত্যসামাজিক বিবর্তনবাদ

সামাজিক বিবর্তনবাদ


আক্ষরিক অর্থে বিবর্তন হচ্ছে ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হওয়া বা বিকশিত হওয়া। বিবর্তনের ধারণা আধুনিক কালের বলা হলেও দেখা যায় প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকরা বিবর্তন সম্বন্ধে অনেক আগে থেকেই চিন্তাভাবনা করেছিলেন। এম্পেদোক্লিস (Empedocles, 495-435 B.C) বিবর্তনের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। যোগ্যতমের আকস্মিক সৃষ্টি ও অযোগ্যের বিলুপ্তি সম্বন্ধে তিনি জোরালো ধারণা পোষণ করতেন। বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল (Aristotle 384-322 B.C)-এর মনেও ধারণা জন্মেছিল নিম্নস্তরের জীব কতগুলো ধারাবাহিক নিয়মের মধ্য দিয়ে উন্নতির পথে অগ্রসর হয়েছে। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী ডারউইন ওয়ালেইচ প্রাণী জগতের পরিবর্তনের ধারাকে উন্মোচন ও ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে ‘ইভ্যুলোশন’ প্রত্যয়টি উপস্থাপন করেন। প্রকৃতির রাজ্যের সর্বক্ষেত্রেই (উদ্ভিদ ও প্রাণী) ক্রমবিকাশের ধারায় একটি সহজ, সরল স্তর থেকে ক্রমাগতভাবে একটি জটিল ও পরিপূর্ণ অবস্থায় রূপান্তরিত হয়। বিবর্তনকে দুভাগে ভাগ করতে পারি:

১. জৈবিক বিবর্তন
২. সামাজিক বিবর্তন 

চার্লস ডারউইন ১৮৫৯ সালে তার ‘The Origin of Species’ গ্রন্থে জীবজগৎ সম্পর্কিত অর্থাৎ জৈবিক বিবর্তনের ধারণা তুলে ধরেন। পরিবর্তন যখন কোনো একটি পূর্ব নির্দিষ্ট বিশেষ পরিণতির অভিমুখী হয় (যেমন: জীব থেকে পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষের পরিণতি অথবা ভ্রূণ অবস্থা থেকে পরিপূর্ণ জৈবিক সত্তায় উত্তরণ) এবং এই পরিণতি তার অন্তর্নিহিত প্রকৃতির অভিব্যক্তি হয় তখন তাকেই প্রকৃত অর্থে জৈবিক বিবর্তন বলে। সমাজবিজ্ঞান বা নৃবিজ্ঞানে এই ধারণাটি ব্যবহৃত হয় মানব সমাজ বা সংস্কৃতির ক্রমাগত বিকশিত হওয়া বুঝাতে, যার নাম দেওয়া হয়েছিল সমাজিক বিবর্তন। সামাজিক বিবর্তন বলতে সমাজের পরিবর্তনকে বুঝায়। এই পরিবর্তনগুলো সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। যদিও এটি নৃবিজ্ঞানের নতুন কিছু নয় কারণ সপ্তদশ দশকে ইতালীয় দার্শনিক ভিকো বিশ্বজনীন ইতিহাস লেখার প্রচেষ্টায় বিবর্তনবাদী সমাজিক প্রগতির ধারণা ব্যক্ত করেন।

ডারউইনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং সমাজে এর স্বীকৃতি বিবর্তনীয় তাত্ত্বিকদের প্রভাবিত করেছিল। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব অর্থাৎ ‘যোগ্যতমের টিকে থাকা” আর এই ধারণাটি ব্রিটিশ সমাজিক তাত্ত্বিক হার্বার্ট স্পেন্সার (১৮২০-১৯০৩) সামাজিক বিবর্তনে ব্যবহার করেছিলেন। যদিও ডারউইনের তত্ত্বের পূর্বে প্রস্তাব করেছিলেন, জৈবিক এবং অতিজৈবিক সকল ক্ষেত্রেই বিবর্তন ঘটে থাকে। শুধু তাই না, বিবর্তনের মাধ্যমে সম্পূরক এবং সরল আকৃতি হয়ে ওঠে বহুরূপী এবং জটিল। তবে বিবর্তনবাদ সম্পর্কে যেহেতু সবচাইতে সুসংহত তত্ত্ব দাঁড় করান এবং সমাজিক বিবর্তনেও এটির প্রভাব রয়েছে সে কারণে এই তাত্ত্বিক ধারা “সামাজিক ডারউইনিজম” নামে পরিচিত। সমাজিক ডারউইনিজমের স্বর্ণযুগ বলা হয় ১৮৬০-১৮৯০ পর্যন্ত সময়কালকে। নৃবিজ্ঞানে প্রথম পঞ্চাশ বছর এই তত্ত্ব একচ্ছত্র আধিপত্য করেছিল। সামাজিক ডারউইনিজমের প্রধান দুটি পূর্বানুমান লক্ষণীয়। প্রথমটি হলো, জীবের মতন সমাজও বিভিন্ন অংশ বা উপাদানে গঠিত। স্পেনসারের বক্তব্য হচ্ছে, জীবন্ত প্রাণীর মতো সামাজিক গঠনও সরল, সমরূপ, অপৃথকীকৃত কাঠামো হতে আরো জটিল এবং অভ্যন্তরীণ ভাবে পৃথকীকৃত গঠন ধারণ করে। সামাজিক ডারউনিজমের দ্বিতীয় পূর্বানুমান প্রাকৃতিক নির্বাচনের মূলনীতিকে ঘিরে। যোগ্যতমের টিকে থাকার ধারণাকে স্পেনসার এবং তার অনুসারীরা প্রয়োগ করেন মনুষ্য সমাজের ক্ষেত্রে। গরিব, অসুস্থ এবং কম যোগ্য মানুষজন বিবেচিত হন “অযোগ্য” হিসেবে। এই দৃষ্টিতে ধরে নেয়া হয়, সমাজের স্বাভাবিক প্রগতির উদ্দেশ্যে, অযোগ্যদের বিলুপ্ত হতে দেয়া উচিত।

সামাজিক ডারউইনবাদ ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় একটি সামাজিকতাত্ত্বিক তত্ত্ব। সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ এবং অসাধু সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতিগুলোকে ন্যায্যতা দেওয়ার হাতিয়ার। সামাজিক ডারউইনবাদীরা যুক্তি দিয়েছিলেন, সর্বোত্তম অভিযোজিত মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সমাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্তরের শীর্ষে উঠেছিল। ইউরোপীয় এবং আমেরিকান উচ্চ শ্রেণি তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রসারিত করার চেষ্টা করছিল, তখন তারা ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান স্পষ্ট ব্যবধানকে ন্যায্যতা দিতে এই তত্ত্বকে ব্যবহার করেছিল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো স্বাভাবিকভাবেই শ্রেষ্ঠ এবং মানব বিবর্তনের সর্বোত্তম স্বার্থে অন্যান্য জাতির উপর তারা নিয়ন্ত্রণ করে, এসব যুক্তি দিয়ে তারা সাম্রাজ্যবাদের যুক্তি দিয়েছিল। পশ্চিমারা নিজেদের স্বার্থের খাতিরে বিবর্তনবাদী ধারণা ব্যবহার করে। ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশের বিস্তার, পণ্যের বাজার ও কাঁচামালের উৎস অনুসন্ধান, নৌ-বাণিজ্যের বিস্তার, খ্রিষ্টীয় ধর্মের সংস্কার, গ্রিক দর্শন প্রভৃতি শর্তের উপস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে তা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। সমাজের উচ্চবর্গীয় স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল বিবর্তনবাদ। শিল্প বিপ্লবের সময় সমাজিক, রাজনৈতিক বৈষম্যের যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো সামাজিক ডারউইনবাদের ধারণাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে। উপনিবেশে স্থানীয় জনগণকে “অসভ্য” এবং “প্রাথমিক অবস্থায়” থাকা বলে চিত্রিত করে নিজেদের শাসনকে বৈধতা দেয়। যেমন, আফ্রিকা ও এশিয়ার উপনিবেশগুলোতে স্থানীয় সংস্কৃতি ও সমাজকে নিম্নতর দেখিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করে।

সাম্প্রতিককালের নৃবিজ্ঞানী হেনরিকা কুকলিক ও স্টকিং মনে করেন, কিছু ঐতিহাসিক শর্ত অর্থাৎ স্কুলিং সিস্টেম, নেতা নির্বাচন, শ্রমবিভাজন, প্রগতির ধারণা, যোগ্যতমের জয়, সারসত্তাকরণ, পরিবার ও বিবাহ প্রথা, মনোজাগতিক ঐক্য ও একেশ্বরবাদী তত্ত্ব ইত্যাদির উপস্থিতিতে বিবর্তনবাদী ধারণা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বিবর্তনবাদী ধারণা মতে, মানুষের মনোজাগতিক রূপ একই তবে বিবর্তনের ফলে কেউ উৎকৃষ্ট বা শ্রেষ্ঠ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে (যেমন ইউরোপীয়রা) এবং কেউ বিবর্তনের ধাপে পিছিয়ে পড়েছে (যেমন অপর জনগোষ্ঠী)। এখন বিবর্তনবাদী বক্তব্য হচ্ছে, যদি এই পিছিয়ে পড়া জাতিকে  যদি পরিচর্যা করা যায় তাহলে তারা সভ্য হয়ে উঠবে। অর্থাৎ এখানে উপনিবেশবাদকে বৈধতা দিয়েছে।

একরৈখিক বিবর্তনবাদী তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রত্যেক সমাজই কয়েকটি নির্দিষ্ট ও বিশ্বজনীন ধাপের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়৷ বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন গতিতে অগ্রসর হওয়ার ফলে যেসব সমাজ অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতিতে বিকশিত হয়, তারা অন্যান্য সমাজ (যাদের বিকাশের গতি ধীর) তাদের থেকে প্রগতি বা উন্নয়নের উপরের ধাপে অবস্থান করে। সামাজিক বিবর্তনবাদীরা সমাজের বিবর্তনকে ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি পর্বে বিভক্ত করেন: অসভ্যতা, বর্বরতা, সভ্যতা ইত্যাদি। লুইস হেনরি মরগান আবার ‘অসভ্যতা ও বর্বরতা’ এই দুই পর্বকে আরও তিনটি স্তরে ভাগ করেন: নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ। অবশ্য সভ্যতার ক্ষেত্রে মর্গান এমন কোনো স্তরীকরণ করেননি এবং সভ্যতাকে দেখেছেন অভিন্ন রূপে, যে সভ্য সমাজের উদাহরণ হলো তৎকালীন ইউরোপ। সমাজকে বিভিন্ন ধাপে বা পর্বে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে এই ধারার তাত্ত্বিকরা প্রাধান্য দিয়েছে বস্তুগত ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে। এই ছাঁচে অসভ্যরা শিকারি ও খাদ্য সংগ্রহকারী; বর্বররা কৃষি কাজ করে; আর সভ্যতার বৈশিষ্ট্য হলো রাষ্ট্রগঠন ও নগরায়ণ। তবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, বিবাহ, পরিবার ও ধর্মীয় ক্যাটাগরিও তারা বিবেচনায় এনেছেন৷ আসলে, বিবর্তনবাদী চিন্তা অনুযায়ী, সমাজের এক অংশের বিবর্তন অন্য অংশেও বিবর্তনীয় রূপান্তর ঘটায়।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত