Homeসাহিত্যবাঙালি মুসলিম ও অসাম্প্রদায়িকতার টানাপড়েন

বাঙালি মুসলিম ও অসাম্প্রদায়িকতার টানাপড়েন


১.
আমার এক ধার্মিক মুসলমান বাল্যবন্ধুর গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। পেশায় অধুনা ডাক্তার। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে সে লিখেছে, ‘ভাইয়েরা, মন্দির ভাঙবেন না, তাদের ধর্মচর্চার সুযোগ দেওয়া আপনার কাজ। তবে পারলে দুই একটি মাজার গুঁড়িয়ে দিতে পারেন। আল্লাহ খুশি হবেন।’

আমি বিরক্ত হইনি। কেবল মনে হয়েছে, সে সম্ভবত সাম্প্রদায়িকতা না বুঝেই অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষ নেওয়ার চেষ্টা করছে। একদিকে অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে অন্য ধর্মকে নিরাপত্তা দেওয়াকে দায়িত্ব বলে প্রচার করছে, অন্যদিকে অন্য মতকে খারিজ করে তাদের ওপর আক্রমণ করার উসকানি দিচ্ছে। যে মানুষ মাজারে মানত করে, পীরকে খোদার ওলি মানে, যে পীরের পানিপড়া নিয়ে মাজারের কাছে দাঁড়িয়ে দু-হাত তুলে চোখের পানি ফেলে খোদার কাছে মনের বেদনা জানিয়ে আত্মতৃপ্তি পায়, সে তো প্রবলভাবে বিশ্বাস করে বলেই নিজের ইচ্ছায় সেখানে যায়। এই বিশ্বাসের ভেতর কপটতা নেই, এই বিশ্বাসের ভেতর জোর করে অন্যমত চাপিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে আলবত সাম্প্রদায়িকতা। রেফারেন্সের মাধ্যমে ধর্মের কাঠামো সম্পর্কে মানুষকে অবগত করা যায় ঠিকই, কিন্তু তা দিয়ে কোনো অকপট বিশ্বাস কিংবা আত্মতৃপ্তির পরিধিকে সীমানা দেওয়া যায় না।

প্রত্যেক মানুষের উপলব্ধি ভিন্ন, একারণে একই ব্যাপারকে দশজন মানুষ দশভাবে বোধের অন্তর্গত করে, উপলব্ধি করে। সে কারণেই একই ধর্মীয় দর্শন থেকে নানা-মতের জন্ম হয়। রাজনৈতিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যে নতুন-মতের জন্ম হয় না সে কথা বলছি না। কিন্তু সাধারণ মানুষ আদতে সে সম্পর্কে অবগত থাকে না। সে অর্থে তার বিশ্বাস নিখাদ। একই ইসলামের পতাকার নিচে যেমন সুন্নি, শিয়া, ইবাদি, আহলে কুরআন, আহলে হাদিস, আহমাদিয়া, সুফি বিভিন্ন মতের দেখা পাওয়া যায়, তেমন খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এবং অন্য ধর্মগুলোতেও যথাক্রমে প্রটেস্টান, ক্যাথোলিক, জিংতু, কুয়ানিন, লূজোং, চেংশি, ‎বজ্রযান, মহাযান, থেরবাদ সহ অনেক মতবাদের দেখা পাওয়া যায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ফলে একই বিষয়ের স্বতন্ত্র উপলব্ধি এই ভিন্ন-মতের একেবারে গোড়ার কারণ। এ কারণে রেফারেন্স আওড়িয়ে কারও বিশ্বাস বদলে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে কাউকে আঘাত না করে, ঘৃণা না করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কোনো কিছু প্রচার করা হলে সেটা সাম্প্রদায়িকতার ভেতরে পড়ে না বলে আমার মত।|

মাজার ভাঙাকে সাম্প্রদায়িকতা মানতে নারাজ বন্ধুকে পরে আমি একটি কাল্পনিক পরিস্থিতি বর্ণনা করি। মনে করা যাক, কোনো গ্রামে আশিটি সুন্নি মসজিদ আছে, কোথা থেকে রাতারাতি একদল শিয়া গ্রামে ঢুকে পড়ল, এবং সত্তরটি মসজিদ দখল করে পুরো গ্রামে শিয়াদের কিছু কানুন প্রণয়ন করতে জোর করল, বলল, সুন্নি নিয়মে নামাজ পড়লেও হবে কিন্তু অন্তত আজানটা শিয়া নিয়মে দিতেই হবে, না হলে তাদের মতের পরিপন্থি হবে, সুন্নি ঘর ভেঙে দেওয়া হবে। সুন্নি কিংবা শিয়া প্রতিটি মসজিদে আজানে অবশ্যই হজরত আলীর নাম দুইবার বলতে হবে। ঐ গ্রামের সুন্নি লোকেরা এই ঘটনাকে কি সাম্প্রদায়িকতা বলবেন না? বন্ধুটি কোনো উত্তর দিতে পারিনি।

বোধ করি, ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটির অর্থ কী, সেটা নিয়ে বাংলাদেশের আম-জনতার স্পষ্ট ব্যাখ্যা জানা নেই, অনেকে এ সম্পর্কে অবগতই না, আর অনেকে জানেন, কিন্তু সেটা যে বস্তুত কী সে বিষয়ে সংশয়ে দোলেন। অনেকে দুই ধর্মের মধ্যে কলহকেই কেবল সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে দেখেন। কিন্তু এই পরিভাষাটির অন্তর্গত সহনশীলতা, ধৈর্য, শ্রদ্ধা, সম্মান কিংবা এই এর ভেতরে জাতিগত যে সম্ভাব্যতা লুকানো, যে সফলতা আর সমর্থতার দিকে পরিভাষাটি ইঙ্গিত করে তা অধিকাংশই জানেন না। সে কারণেই বাংলাদেশে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটি তার মর্মার্থের আংশিক সফলতাও পায়নি।

২.
আমরা বাংলায় কথা বলি। বাংলায় যে কথা বলে সে বাঙালি, মোটা দাগে সবাই তা-ই জানে। কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখব, বাঙালি পরিভাষাটির অর্থ বাংলা ভাষার ভেতরেই কেবল সীমাবদ্ধ নয়, এর সঙ্গে আচার-আচারের সংযুক্তি রয়েছে। যেমন, অস্ট্রিয়ান এবং জার্মান দুই জাতিরই মাতৃভাষা জার্মান। একই ভাষায় কথা বললেও তাদের ভেতরকার আচার-আচরণের মূলগত বহু পার্থক্য বিদ্যমান। অস্ট্রিয়ানরা জার্মান ভাষায় কথা বললেও তারা কিন্তু তাদেরকে জার্মান বলে দাবি করে না। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রীকান্ত উপন্যাসে লিখেছিলেন, ‘মাঠে বাঙালি ও মুসলমান ছেলেদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ, সে খেলা চলাকালে বাঙালি ও মুসলমানদের মধ্যে মারামারি লেগে যায়, এতে উপন্যাসের নায়ক শ্রীকান্তের পিঠে দুই চার ঘা পড়তেই সে দৌড়ে পালাতে গিয়ে ইন্দ্রের দেখা পেল।’

এখানে শরৎবাবু মুসলমানকে বাঙালি না বলে সাম্প্রদায়িকতা করলেন কিনা সে প্রশ্নে না গিয়ে, দুই ধর্মের মেটাফিজিকাল জায়গা থেকে বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করা যাক।

বাঙলা অঞ্চলে দুই সংস্কৃতির সংঘর্ষ নতুন নয়। ইসলাম আসার বহু আগেই যখন বৈদিক আর্যরা এই অঞ্চলে আসেন তখনও এই সংকট দেখা দেয়। ড. অতুল সুর লিখেছেন, ‘বৈদিক আর্যরা বাঙলাদেশের লোকদের বিদ্বেষপূর্ণ ঘৃণার চোখে দেখতেন। এটার কারণ— দুই বিপরীত সংস্কৃতির সংঘাত’ [বাঙলা ও বাঙালি, পৃ. ১২]। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্ম বা প্রাচীন হিন্দুধর্ম যখন বাংলায় প্রবেশ করেছে তখন এই সংকট দেখা দেয়নি। ‘ব্যাপকভাবে ব্রাহ্মণরা বাঙলায় আসতে শুরু করে গুপ্তযুগে (গুপ্তযুগ আনুমানিক খ্রিষ্টীয় ৩২০ থেকে ৫৫০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে)। ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুপ্রবেশের পূর্বে বাঙলাদেশে বাঙলার আদিম অধিবাসীদের ধর্মই অনুসৃত হতো। ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনেক কিছু পূজা পার্বণের অনুষ্ঠান, যেমন দুর্গাপূজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নবপত্রিকার পূজা, নবান্ন, পৌষপার্বণ, হোলি, ঘেঁটুপূজা, চড়ক, গাজন প্রভৃতি এবং আনুষ্ঠানিক কর্মে চাউল, কলা, কলাগাছ, নারিকেল, সুপারি, পান, সিঁদুর, ঘট, আলপনা, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, গোময় এবং পঞ্চগব্যের ব্যবহার ইত্যাদি সবই আদিম অধিবাসীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল।’ (বাঙলা ও বাঙালির বিবর্তন, ড. অতুল সুর, পৃ. ৮৪-৮৫)। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্মের তথা প্রাচীন হিন্দুধর্মের সঙ্গে বাঙলার আদিম মানুষের সংস্কৃতির টক্কর লাগেনি। তার পেছনে মূল কারণ হল, সে সময়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মের সুনির্দিষ্ট কোনো আচার কাঠামো না থাকা ও বাঙলার মাতৃতান্ত্রিক আদিম অধিবাসীদের সংস্কৃতি হিন্দুধর্মের মূল বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হওয়া। অধিবাসীদের সংস্কৃতি অভিযোজনের মধ্য দিয়ে হিন্দুরা বাঙালি হতে গিয়ে এক সময়ে এতই বাঙালি হয়ে ওঠে যে, হিন্দুর সঙ্গে আদিম বাঙালির সাংস্কৃতিক পার্থক্য আর থাকে না। যতই সময় যায় হিন্দুর ধর্ম আর তার সংস্কৃতির একে অপরের মর্মে ঢুকে যায়।

হিন্দু ধর্মে বর্ণবাদ প্রথা বহু আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত। এই ধর্মে মৌলিক বিশ্বাসের সঙ্গে বর্ণবাদ গভীরভাবে প্রোথিত। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের পুরুষ সূক্তমে বলা হচ্ছে:

১১. যখন তারা পুরুষের আরাধনা করে, আর তাকে বিভক্ত করে তখন পুরুষের মুখ কী, তাঁর বাহুকে কী বলে ডাকে? তাঁর উরু কী? পা কী?

১২. ব্রাহ্মণ ছিল তাঁর মুখ, দুই বাহুর মধ্যেই ছিল ক্ষত্রিয়। তাঁর উরু বৈশ্য হয়ে ওঠে, তাঁর পা থেকে শূদ্রের জন্ম হয়। [বাংলা অনুবাদকের নাম অজানিত]

এখানে পুরুষ হচ্ছে মহাজাগতিক সত্তা বা স্ব, চেতনা। সাংখ্য দর্শনে পুরুষ মহাজাগতিক নীতি, বিশুদ্ধ চেতনা। অর্থাৎ এই গোত্রগুলো যদি তার স্ব-স্থানে অধিষ্ঠিত থাকেই তবেই পুরুষের স্থির থাকবে। না হলে নীতি ভেঙে পড়বে। হিন্দু ধর্মের অধিবিদ্যায় সমতার ধারণা যেন মৌলিক নয়। সবাই সেখানে সমান হওয়া সম্ভব নয়। ব্রাহ্মণের সমান না হলে একজন শূদ্র প্রতিবাদ করেন না, পাছে পুরুষের স্থিরতা থাকে না। সে কারণে গতজন্মের পাপকে দায়ী করে তিনি মনকে শান্ত করেন।

মুসলমানের ধর্মে এই অসমতার স্থান নেই। প্রতিটি মুসলমান আল্লাহর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। সবার অধিকার সমান। সব বর্ণ, মত ভুলে মসজিদে এক কাতারে নামাজে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। মুসলমানি অধিবিদ্যার সঙ্গে এখানেই হিন্দুর অধিবিদ্যার বিরাট ফারাক, দুইয়ের ভেল্টশাউঙ, ওয়ার্ল্ডভিউ বা বিশ্বউপলব্ধির ধরণ আলাদা। মুসলমানের আল্লাহ আর হিন্দুর ভগবান, শাব্দিক অর্থে এক হলেও অবচেতন মনে শব্দটি যে অর্থ তৈরি করে সেখানে তা আলাদা। রক্তে মিশ্রণকে দূষণ মনে করা বাঙালি আদিবাসীর ভেতরে বেড়ে ওঠার কারণে রক্ত রক্ষা করতে চাওয়া হিন্দুর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়েছে, পরে বর্ণপ্রথা তাকে আরও বেশি বাধ্য করেছে। সে বেরিয়ে পড়তে চায় না, বরং নিজের ভেতরে আরও বেশি ঢুকে নিজের স্বকীয়তা, নিজের মৌলিকত্ব, নিজের ‘জাত’ রক্ষা করতে চায়। এ কারণে বাচার তাগিদে সে ফারসি লিখতে পড়তে শিখলেও ঘরে সে ভাষায় কথা বলেনি। সাসানীয় সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার আগে আরমাইক অক্ষরে লেখা হতো ফারসি। পারস্যে মুসলমানদের আগমনের পরও নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় থাকায় আরবি পারস্যের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি ঠিকই কিন্তু আরমাইক হরফ সরিয়ে আরবি হরফে ফারসি লেখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পারস্যের নব্য মুসলমান আরবি ভাষা গ্রহণ না করলেও আরবি অক্ষর গ্রহণ করেছে। কিন্তু একইভাবে ভারতবর্ষে ফারসি যদি সংস্কৃত বা পরে হিন্দি অক্ষরে লেখার প্রচলনও করা তাহলেও কি হিন্দুরা মনে প্রাণে তা গ্রহণ করত? খুব সম্ভবত না। কারণ, প্রাচীনকাল থেকেই সংস্কৃত ভাষাকে উঁচু হিন্দুরা অচ্ছুত রেখেছে এবং একই সঙ্গে জাত রক্ষা তার অধিবিদ্যার শাঁস।

কিন্তু মুসলমানের জাত রক্ষার দায় নেই। তার অধিবিদ্যার গন্তব্য হিন্দুর থেকে আলাদা। সে বেরিয়ে পড়তে চায়, ছড়িয়ে পড়তে চায়। তার ধর্মের মজ্জার রং উপমহাদেশীয় ধর্ম থেকে ভিন্ন, ঈশ্বরের প্রতিরূপ সে কল্পনা করে না, তার ধর্ম যেখানে গড়ে উঠেছে তার আকাশ, মাটি আলাদা। সে কারণে বাঙলার বাতাসে বেড়ে উঠলেও, ক্লাসিক বাঙালির মতো ভাত-মাছ তার কাছে অনিবার্য হলেও মনস্তাত্ত্বিকভাবে সে হয়ে ওঠে অন্য কেউ। বাঙালিয়ানা তার হাতে থাকে ঠিকই, তবু বুকপকেটে রাখতে গিয়েও যেন বারবার ব্যর্থ হয়। এর পিছনে অবচেতনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে তার শিশুকাল, চারপাশের পরিবেশ। ক্লাসে পড়েছিলাম ফ্রয়েডের আইসবার্গ থিওরি। ফ্রয়েড বলেছেন, সচেতনতা আর অচেনতার মাঝখানে অবচেতনের অবস্থান। অবচেতনকে আমরা সাদা চোখে বুঝতে পারি না, তবে সে আমাদের মানসকে, আচরণকে প্রভাবিত করে। জঁ পিঁয়াজের কগনিটিভেন এন্টভিকলুঙ্গ থিওরিতে আসিমিলাৎসিওন কিংবা আত্তীকরণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিশু যেখানে বড় হয়, সে চেতনে অবচেতনে পরিবেশ থেকেই সবকিছু আত্মীকরণ করে। বড়ো হয়ে যদি তার পরিবেশের পরিবর্তন ঘটে তাহলে নতুন অভিজ্ঞতাগুলো শিশুকালে প্রতিষ্ঠিত কাঠামো এবং বাস্তব পরিস্থিতিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। মানব জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে উত্তরণে এর প্রভাব থাকে।

সাধারণ মুসলমান শিশুর ক্ষেত্রে কী ঘটে? তার জীবনের অধিকাংশ যাপনই সর্বভারতীয়, অধিকাংশ সময়ই সে ক্লাসিক বাঙালির মতোই চলাফেরা করে, বাংলায় কথা বলে। একইসঙ্গে তার অধিবিদ্যার আলাদা পথে পরিবার থেকেই পদার্পণ করে। হিন্দুর সঙ্গে গহিন বন্ধুত্ব হতে তার সমস্যা নেই, ধুতি, গামছা কিংবা শাড়িও সে পরতে পারে নিঃসঙ্কোচে, পাখি আঁকা নকশীকাঁথা সে উচ্ছ্বাস নিয়ে তৈরি করে, ফতুয়ায় টেপা পুতুলের ছবি তাকে বিরক্ত করে না। সে হিন্দুর পূজায় যায় কিন্তু মূর্তির কাছে মাথা নত করে না। শূকরের মাংস আর মূর্তির আশেপাশেও যাওয়া যেন তার ধাতে নেই। অনেক মুসলমান বাঙালিকে জানি, যারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকেই সচেতনভাবেই ধর্মত্যাগী, কিন্তু শূকরের মাংস খাওয়ার চেষ্টা কখনো করতে চান না। বলেন রুচিহীনতার কথা। কিন্তু এর পেছনে তার অবচেতনে গেঁথে থাকা অধিবিদ্যার ছাপ কি দায়ী নয়? না, শূকরের মাংস বাঙালি সংস্কৃতির কোনো বিশেষ অংশ নয়, তবু শুধুমাত্র মানুষের অবচেতনে গেঁথে থাকা অধিবিদ্যার প্রভাবকে বোঝাতে এর সূত্রপাত।

সাধারণ মুসলমান কোনো প্রাণীর প্রতিকৃতি, মূর্তি, ভাস্কর্য আর মোটিফকে একনামে মূর্তি বলে বিবেচনায় আনে। ভাস্কর্য কী এবং কেন, এটা বুঝতে যে সামগ্রিক সচেতনতার দরকার তার চল বাংলাদেশি মুসলমান সমাজে নেই। কিন্তু ক্লাসিক বাঙালির আচারের ভেতর কোনো বিমূর্ত ধারণাকে মূর্ত করে তোলার চল বহু পুরানো। বাংলায় কথা বলা মুসলমানের মানসিক দোদুল্যমানটা তৈরি হয় এখানে। একদিকে ধর্মের অধিবিদ্যা সর্বভারতীয় সত্তার অবচেতন করোটির ভেতর লালন করার কারণে আরব হয়ে উঠতে পারে না, অন্যদিকে চিরায়ত বাঙালির সংস্কৃতি পুরোপুরি গ্রহণ করে নিখাদ বাঙালি হয়ে উঠতে পারে না, ফলে তার ভেতরে সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের অপূর্ণতা দেখা দেয়। একটি উদাহরণ দিলে আরও পরিষ্কার হবে।

পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার কথা ধরি। (মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালি সংস্কৃতিকে পুরোপুরি বিম্বিত করে কিনা সেই তর্ক-বিতর্ক এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়)। শোভাযাত্রা নিয়ে মুসলমানের মুখ থেকে প্রায়ই বহু সমালোচনা শোনা যায়। পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন করতে বাঙলায় কথা বলা মুসলমানের কোনো সমস্যা নেই। সে সানন্দে নিজের উৎসব বলে শাড়ি পরে, লুঙ্গি গামছা পরে পান্তা-ইলিশ খায়, গান-বাজনা করতেও তার অত সমস্যা নেই, কিন্তু যখনই মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রাণীর মোটিফ দেখে, মুখোশ দেখে, সে ভেতরে ভেতরে হোঁচট খায়। বটতলায়, রাস্তার ধারে কাসুন্দি মাখানো আমড়া বিক্রি করা সাধারণ মুসলমান ফুল-কাটা পাখি-আঁকা লাল-সাদা পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে পহেলা বৈশাখের গানে মাথা দোলাতে দোলাতে শোভাযাত্রার মোটিফকে সরলরেখায় পুজোর মূর্তি বলে ভ্রম করে। কেউ এর বিপক্ষে হিন্দু দেবদেবীর কথা তুললে সে ‘ঠিক ঠিক’ বলে ওঠে। কেউ তাকে বোঝাতে সক্ষম হয় না। অনুষ্ঠানটির অনেক বিষয়ের সঙ্গে সে একাত্মতা প্রকাশ করলেও এই বিষয়ে ভেতরে ভেতরে যেন এক হতে পারে না। সে কীসের যেন অভাববোধ করে। পুরোটা বাঙালি হতে না পারার কারণে তার আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আরও বাড়ে। আর তাতে উৎসবটা বাংলাদেশি মুসলমানের ভেতরে সার্বজনীন না হতে পেরে উপ-সংস্কৃতিতে পরিণত হওয়ার অবস্থা হয়। অথচ বাংলাদেশি মুসলমানের এই সংকট বিশ্লেষণ করে, প্রাচীন বাঙালি সংস্কৃতির পুরোটা অনুকরণ না করে, যদি ক্লাসিক বাঙালিয়ানাকে সংস্কার করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রজেক্ট ও শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার লাগাম টেনে ধরা যেত তাহলে বাংলাদেশি মুসলমানের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের দ্বিধা, দ্বান্দ্বিকতা ও অপূর্ণতা ঘুচত; সে হয়ে উঠত নয়া বাঙালি।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত