Homeসাহিত্যকবিতা দাসত্ব নয় আদর্শ মানে : শ্যামল নাথ

কবিতা দাসত্ব নয় আদর্শ মানে : শ্যামল নাথ


সাহিত্য বিভাগের নির্ধারিত প্রশ্নে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন লেখক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা শ্যামল নাথ। তার জন্ম ১৯৯০ সালের ১৮ জানুয়ারি লক্ষীপুর জেলার হাসন্দী গ্রামে। প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘সার্কাসের ঘোড়া’, “ঝরা পাতায় জল” ও “মিথ্যার মতন সুন্দর”।

বাংলা ট্রিবিউন: কোন বিষয় বা অনুভূতি আপনাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে?

শ্যামল নাথ: প্রথমত— বস্তুবাদ, ভাববাদ ও সংশয়বাদের যে দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্ব থেকে তাত্ত্বিক অনুভূতির যে ঘ্রাণ আমি অনুভব করি তাই আমাকে প্রেরণা দিয়ে যায়। আপনি প্রেরণার কথা বললেন, সেই প্রেরণার আবার উৎকর্ষতার রয়েছে নানান দিক থেকে নানান শৈল্পিক ও ব্যক্তিক ভাব-দর্শন এতে এসে মিলিত হয়েছে। একদিনে বা কোনো এক কাম উত্থিত সন্ধ্যায় তো আর প্রেরণা সৃষ্টি হয়নি, হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, আমি প্রেরণা পাই প্রকৃতি থেকে, মানুষ থেকে, প্রেম ও আত্মিক সত্তার এক তুলনারহিত মেলবন্ধন থেকে। আমি যদিও ‘প্রেরণা’কে ভিন্নভাবে দেখি তাহলে বলব— কবিতা যেমন দাসত্ব মানে না, মানে আদর্শ। তেমনিভাবে, কবির একটা শিল্পদর্শ থাকে, যা কবি থেকে কবিতা থেকে মানে পরস্পর থেকে ভিন্নতর। উন্নতরও বলা যেতে পারে।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি কী ধরনের থিম বা বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

শ্যামল নাথ: বাংলা কাব্য ভাষার ক্ষেত্রে পঞ্চদশ শতক থেকে একটা সুনির্দিষ্ট ইতিহাস পাওয়া যায়। সেই সময়ে সাহিত্যের সবচেয়ে বড় লক্ষণ ছিল— ধর্মনির্ভরতা। ফলশ্রুতিতে, পুরাণের অবলম্বন অনিবার্য হয়ে ওঠে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলা পদ্যে বেদ, উপনিষদ ও পৌরাণিক সাহিত্যের ভাব অপরিসীম। আমার পদ্য ভাষ্যের বিষয় দেশ, সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস, প্রকৃতি, প্রেম, দ্বন্দ্ব, বস্তুবাদ, বৈশ্বিক ভাষ্য, পরিবেশ ও দ্বান্দ্বিকতা।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ব্যক্তিমনের নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ, অকৃত্রিম দেশাত্মবোধ, বাংলার নিসর্গ-প্রকৃতি, মানব-মানবীর প্রেম প্রভৃতিকে উপজীব্য করে আমার কবিতার জগৎ গড়ে উঠেছে। আরেকবার জীবন পেলে আমি শুধু ‘কবিতা ও উচ্চাঙ্গ সংগীত’ নিয়েই থাকতাম।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণায় লেখেন, নাকি ধীরে ধীরে শব্দ সাজান?

শ্যামল নাথ: আদতে আমরা সকলেই কোনো এক ঐশ্বরিক অনুভূতি দ্বারা গ্রস্ত হয়েই লিখতে বসি। সেখানে ঈশ্বর থাকেন কি বা না থাকেন সেটা বিবেচ্য না হলেও আত্মাকে অনুভবের ক্যানভাসে দেখতে পাই বলেই লিখি। আমার ক্ষেত্রে কোথা থেকে যেন কয়েকটি বাক্য এসে ধরা দেয় আত্মায় ও নিউরনে। সেটাকে অনুপ্রেরণাই বলা চলে, অনুপ্রেরণা না থাকলে আমি লিখতে পারতাম না। তবে, প্রেরণাটা মোটেও তাড়না নয়। ফলে প্রেরণা পেয়ে যায় ভাষা। ভাষা তৈরি করে উত্তুঙ্গ মানের শিল্প।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার কবিতার ভাষা ও শৈলী কীভাবে বেছে নেন?

শ্যামল নাথ: এক্ষেত্রে আমি নিজস্ব একটা কৌশল আয়ত্ত করতে পেরেছি। তা একদিনে হয়ে ওঠেনি। অধিক পাঠ আমাকে এই শিক্ষাটা দিয়েছে। যাতে আমি বেশি না লিখি একই সঙ্গে যা লেখা হয়েছে তা আর যেন না লিখি।

বাংলা ট্রিবিউন: কোন কোন কবির প্রভাব আপনার লেখায় আছে?

শ্যামল নাথ: এভাবে বলা খুব কঠিন আমার জন্য। তবে লেখালেখির শুরুর দিকে আমি ইয়োহান ভল্ফগাং ফন গ্যোটে, দান্তে আলিগিয়েরি, পাবলো নেরুদা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে রপ্ত করার চেষ্টা করেছি। আমার বিশ্বাস আমার কবিতায় আমি যেকোনো প্রভাব বলয় থেকে বের হতে পেরেছি।

বাংলা ট্রিবিউন: কথাসাহিত্যের চর্চা করেন? এ চর্চা আপনার কবিতায় কতটুকু প্রভাব রাখে?

শ্যামল নাথ: কথাসাহিত্যের চর্চা আমি করি। আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ “মিথ্যার মতন সুন্দর” ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে। নতুনত্ব ও অভিনত্বের যে আধুনিকতা সেই আধুনিকতা আমাকে গ্রাস করে। গদ্য লিখলে অনেক সময় কবিতার চেহারা ও চরিত্র নানান ভাবে পাল্টায়। অনেকক্ষেত্রে, গদ্য যেমন পদ্যে লিখতে সাহায্য করে, তেমনিভাবে বাধাও সৃষ্টি করে। এই বাধা প্রেম-অপ্রেমের মতন। জীবনে আসলে সব কিছুর সাথে সকল কিছুর এক ধরনের যোগসূত্র সাথে। সেক্ষেত্রে পদ্য আমাকে গদ্য লিখতে সহায়তা করে বলেই আমার বিশ্বাস। মাঝেমাঝে মনে হয় এটা বিপরীত তত্ত্বের দ্বন্দ্ব।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার প্রথম কবিতার বই সম্পর্কে কিছু বলুন। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন ছিল?

শ্যামল নাথ: কবিতা ও কবি কখনো শান্তি পায় না। কবিকে-কবিতাকে বোধিসত্ত্বের যে মর্যাদা দিতে হয় তা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আমার প্রথম কবিতার বই ‘সার্কাসের ঘোড়া’ শিল্পমান উত্তীর্ণ হলেও আধুনিকতা ও বাস্তবতার নিরিখে কিছু প্রশ্ন রেখে যায়। যদিও এখন আমাদের কবিতা ব্যক্তি বৃত্তে আবদ্ধ এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে কাব্য ব্যক্তিত্বের মহিমা প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। আধুনিকতা, উত্তর আধুনিকতা যেই পতাকাই আমি আমার কবিতার অভিব্যক্তিকে ওড়াই না কেন তার একটা প্রত্যয় ও প্রত্যাশা রয়েছে। গত দেড় দশক ধরে লিখে আসছি, কিন্তু লিখেছি খুবই কম। তিনটি বই মাত্র, এরমধ্যে একটি গল্পগ্রন্থ।

অনুভূতির কথা জানতে চাইলেন, অনুভূতি তো সময়ের পাটাতনে তরঙ্গায়িত হয়। কখনো ঢেউটা আছড়ে পড়ে কখনওবা ঢেউটা শান্ত হয়ে নদীর কিনারে মিতালি ঘটায়। প্রথম বই সব সময় অন্যরকম কিছু, এক্ষেত্রে ভাষায় প্রকাশ আসলে কষ্টসাধ্য ব্যাপারই বটে। আরে প্রেম তো আর কেবল ভাষায় প্রকাশ করে বুঝানো যায় না। এতে অনুভূতি প্রধান হয়ে ওঠে। ওই যে অনুভূতির কথা বললাম, প্রথম বই এক ‘অনুভূতির নাম’।

বাংলা ট্রিবিউন: সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ঘটনা কি আপনার কবিতায় প্রভাব ফেলে? যদি ফেলে, তবে কীভাবে তা প্রকাশিত হয়?

শ্যামল নাথ: সংবেদনশীল সকল মানুষ মাত্রই সমকালীন, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। নিশ্চয় আমি এর ব্যতিক্রম নই। আমার কবিতার চেয়েও ছোটগল্পে এর প্রভাব সমকালীন, ঐতিহাসিক ও আরো বেশি প্রাসঙ্গিক ও একই সাথে বৈশ্বিক। কবিতা প্রকাশভঙ্গি, শব্দ চয়নে ও নির্মাণ শৈলীতে প্রভাব ফেলে। এই প্রভাব আমার কবিতায় প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে নানান সময়ে নানান ভাবে প্রকাশ করে থাকি। কখনো উপমায়, উৎপ্রেক্ষায়, অলংকার ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে।

বাংলা ট্রিবিউন: পাঠকদের মন্তব্য আপনার লেখায় কোনো পরিবর্তন আনে?

শ্যামল নাথ: পাঠকের মন্তব্য আমাকে বিচলিত করে না। কেউ যদি কবি বলে সম্বোধন করে তাতেও আমার অভিব্যক্তির যেমন পরিবর্তন হয় না, কেউ না বললেও আমি অখুশি হই না। আমি আমার সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন। ব্যক্তি মানুষ হিসেবেও স্বাধীন থাকতে চেয়েছি বারবার। এর চেয়ে অধিক ভাষ্য নেই পাঠকদের মন্তব্যের বিষয়ে।

বাংলা ট্রিবিউন: ভবিষ্যতে কী ধরনের কবিতা লিখতে চান? নতুন কোনো ধারা বা শৈলীতে কাজ করার ইচ্ছা আছে কি?

শ্যামল নাথ: আমি যে বিষয়গুলো নিয়ে লিখে আসার চেষ্টায় ব্রত রয়েছি সেই পথেই এগিয়ে যেতে চাই। তবে, নিরীক্ষাধর্মী কাজ হতে পারে। বিবেচনায়ও নেওয়া যেতে পারে। নিশ্চয় সময়, সুযোগ, পাঠন, পঠন এবং বোধ হয়ত নতুন শৈলী সৃষ্টিতে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে ভবিষ্যৎই একমাত্র দ্রষ্টা, আমি কেউ নই। উপলক্ষ্য মাত্র।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত