Homeলাইফস্টাইলভয় কখন মানসিক সমস্যা

ভয় কখন মানসিক সমস্যা


পাহাড়ের শীর্ষে দাঁড়িয়ে বা সাপ ও মাকড়সার মতো প্রাণীর কাছাকাছি থাকলে ভয় পায় অনেকেই। তবে কিছু মানুষের জন্য এই ভয়গুলোর প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া বা আতঙ্ক আসলে বিপদের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে যায়। এমন ক্ষেত্রে এসব ব্যক্তির মধ্যে ফোবিয়া বা অহেতুক ভয় দেখা যেতে পারে।

যেকোনো ফোবিয়া একধরনের মানসিক অবস্থা। একটি নির্দিষ্ট বস্তু বা পরিস্থিতি সম্পর্কে অতিরিক্ত ভয় বা উদ্বেগকে ফোবিয়া বলা যায়। সাধারণত কিছু মানুষ মাঝেমধ্যে বলেন, তাদের কোনো কিছু নিয়ে ফোবিয়া রয়েছে, যেটা তারা ভয় বা সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে চলে। তবে মনোবিজ্ঞানে ভয়কে কখন ফোবিয়া বা মানসিক সমস্যা হিসেবে গণ্য করা হয়, তা নির্ভর করে সেই ভয়টির তীব্রতা এবং এটি ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনকে কতটা প্রভাবিত করে তার ওপর।

ফোবিয়া হিসেবে গণ্য হতে, যেকোনো ভয়কে নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে অনুভূত হতে হয়—অর্থাৎ, যখনই কেউ সেই নির্দিষ্ট বস্তু বা পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন, তখনই সেই ভয় অনুভূত হবে। এটি একজন ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে বাধা সৃষ্টি করতে হবে, যেমন—তাদের শখ, সম্পর্ক বা কাজের ওপর প্রভাব ফেলবে।

কানাডার টরন্টো মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটির ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মার্টিন অ্যান্টনি ফোবিয়াগুলোকে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেন—

প্রাণী: সব প্রাণী এই ক্যাটাগরির মধ্যে পড়ে। সাপ ও মাকড়সা সাধারণ অনুঘটক হিসেবে রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাকড়সার প্রতি ফোবিয়া বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যার ২ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভাবিত করে।

প্রাকৃতিক পরিবেশ: প্রকৃতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, যেমন—উচ্চতা, পানি বা বৃষ্টি এবং ঝড়ের ভয় কিছু উদাহরণ। এগুলো প্রকৃতির প্রভাব থেকে সৃষ্টি হওয়া ফোবিয়ার অন্তর্ভুক্ত।

রক্ত, আঘাত, ইনজেকশন: এই ফোবিয়াগুলো সুঁই, অস্ত্রোপচার, রক্ত বা এ রকম উদ্দীপনার প্রতি ভয়কে অন্তর্ভুক্ত করে।

অবস্থান বা পরিস্থিতি: এই ফোবিয়াগুলো নির্দিষ্ট পরিস্থিতি বা পরিবেশে থাকার ভয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। গাড়ি চালানো, বিমান ভ্রমণ এবং লিফটের মধ্যে থাকা এর কিছু সাধারণ উদাহরণ।

অন্যান্য: এই ক্যাটাগরিটি এমন সব ফোবিয়া ধারণ করে যা অন্যান্য চারটি ক্যাটাগরির মধ্যে পড়ে না। যেমন: ক্লাউন বা সাজানো চরিত্রের প্রতি ভয়। অ্যান্টনি ‘মানুষ যেকোনো কিছু থেকেই ভয় পেতে পারে’।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া পারেলম্যান স্কুল অব মেডিসিনের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট সান্দ্রা কেপালডি বলেন, কখনো কখনো ফোবিয়া একটি ট্রমাটিক ঘটনা (দুর্ঘটনা, সহিংসতা, দুর্যোগের শিকার হয়েছেন, মর্মান্তিকভাবে প্রিয় কারও মৃত্যু দেখা) বা প্যানিক অ্যাটাকের (উদ্বেগজনিত মানসিক রোগ) পর তৈরি হয়, যা পরবর্তীকালে ওই পরিস্থিতির নিয়ে নিজের মনে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি গাড়ি চালানোর সময় প্যানিক অ্যাটাক অনুভব করেন, তবে তিনি আবার গাড়ি চালানোর জন্য ভয় পেতে পারেন। কারণ ওই ব্যক্তি ভাববেন যে তিনি আবার প্যানিক অ্যাটাকের শিকার হবেন এবং দুর্ঘটনা ঘটাতে পারেন।

তবে, কখনো কখনো ফোবিয়া কোনো নির্দিষ্ট অনুঘটক ছাড়াও তৈরি হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে, এসব ফোবিয়া এমন কিছু নিয়ে হয়ে থাকে যা আসলে বিপজ্জনক—যেমন উচ্চতা থেকে পড়ার ভয়। তবে ব্যক্তির ভয় বাস্তব ঝুঁকির তুলনায় অনেক বেশি হয়ে যায়।

মনোবিজ্ঞানী কেপালডি বলেন, ‘এই উদ্বেগ ভয় এর সঙ্গে যুক্ত থাকে। এটি আসলে দুটি বিষয় অতিরিক্তভাবে মূল্যায়ন করে—এক, যে তারা হয়তো কোনো বিশেষ বস্তু বা পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে এবং তারা ফল খারাপ হবে বা আরও তীব্র হবে।

অ্যান্টনি বলেছেন, যারা একধরনের উদ্বেগজনিত রোগে আক্রান্ত, তাদের অন্য কোনো উদ্বেগজনিত রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই, বিশেষ ফোবিয়া অনেক সময় সাধারণ উদ্বেগ বা প্যানিক ডিজঅর্ডারের সঙ্গে উপস্থিত হতে পারে। কখনো কখনো, এই রোগগুলো একে অপরের সঙ্গে মিশে এমনভাবে মিলিত হয় যে, সেগুলো সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে।

মনোবিজ্ঞানী অ্যান্টনি একবার এমন একজন নারী রোগীকে চিকিৎসা করেছিলেন, যিনি সামাজিক উদ্বেগের পাশাপাশি গাড়ি চালানোর ব্যাপারেও ভয় পেতেন। তবে, তিনি শেষমেশ বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর গাড়ি চালানোর ভয় আসলে কোনো ফোবিয়া নয়। তিনি গাড়ি দুর্ঘটনার ভয় পেতেন না, বরং তিনি ভয় পেতেন যে, অন্যান্য চালকেরা তার চালানো দক্ষতা নিয়ে বিচার করবেন। তার ক্ষেত্রে, গাড়ি চালানোর ভয় তার সামাজিক উদ্বেগের একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল, বিশেষ ফোবিয়া নয়।

অ্যান্টনি আরও বলেন, ‘সব সময় স্পষ্টভাবে রোগ নির্ণয় করা যায় না এবং আপনি সব সময় মানুষ যে পরিস্থিতি নিয়ে ভয় পায়, সেটার ওপর নির্ভর করে বিচার করতে পারবেন না। আপনাকে এটা ভাবতে হবে কেন তারা সেই পরিস্থিতি নিয়ে ভয় পায়।’

সৌভাগ্যবশত, ফোবিয়া দূর করার জন্য অত্যন্ত কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। এ রকম একটি চিকিৎসা পদ্ধতি হলো ‘এক্সপোজার থেরাপি’, যেখানে রোগী ধীরে ধীরে একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে তাদের ভয় মোকাবিলা করে। উদাহরণস্বরূপ, যে ব্যক্তির সাপের প্রতি ফোবিয়া আছে, তিনি প্রথমে একটি কাগজে সাপের মতো একটি কার্টুন আঁকা রেখা দেখতে পারেন। তারপর সাপের একটি কার্টুন ছবি দেখবেন। এরপর সাপের একটি ছবি এবং অবশেষে বাস্তব সাপের মুখোমুখি হতে পারেন।

এই চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বোস্টন ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর অ্যাংজাইটি অ্যান্ড রিলেটেড ডিজঅর্ডারের মনোবিজ্ঞানী এলেন হেনড্রিকসেন বলেন, ‘আমরা রোগীকে তাদের স্বস্তিকর পরিবেশের বাইরে ঠেলে দিতে চাই, কিন্তু প্যানিক জোনে নয়। এই দুইয়ের মধ্যে যে অঞ্চলটি আছে, সেটাকেই আমি “শিক্ষণ ক্ষেত্র” বলি। আমরা এমন কিছু করি যা একটু কঠিন এবং তা আমাদের উদ্বেগকে উদ্দীপিত করে। এরপর যখন ভীতিকর ফলাফলটি ঘটে না, তখন আমাদের ভয়টি দুর্বল হয়।’

এই প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ রোগীর হাতে থাকে। এখানে রোগী কোনো উদ্দীপনার মাধ্যমে অবাক হয় না এবং তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে কীভাবে তারা এগিয়ে যেতে চায়। রোগীরা থেরাপিস্টের অফিসে চিকিৎসা শুরু করতে পারে এবং ধীরে ধীরে বাস্তব জগতে চলে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, লিফটের প্রতি ফোবিয়া থাকলে, একজন রোগী প্রথমে লিফটের ছবি বা ভিডিও দেখতে পারে। তারপর ধীরে ধীরে তারা নিজে একটি বাস্তব লিফটে উঠতে পারে।

এই প্রক্রিয়ার পুরোটা সময় রোগীকে তাদের উদ্বেগ পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে মনোবিজ্ঞানীরা, তবে তাদের আতঙ্কের মধ্যে রাখা হয় না।

কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে, মনোবিজ্ঞানীরা এক্সপোজার থেরাপির সঙ্গে অতিরিক্ত একটি থেরাপি সুপারিশ করতে পারেন। অ্যান্টনি বলেছেন, এটি সাধারণত রক্ত, আঘাত বা ইনজেকশনের ভয়গুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রক্তের ফোবিয়া থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ এবং ইনজেকশনের সুঁইয়ের ফোবিয়া থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে অর্ধেকের মতো মানুষ অচেতন হয়ে যাওয়ার ভয় অনুভব করেন। এটি ভ্যাসোভ্যাগাল প্রতিক্রিয়া নামে পরিচিত। এটি একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রতিক্রিয়ার কারণে হয়। যারা বেশি অচেতন বা অজ্ঞান হয়ে যান, তাদের মধ্যে সাধারণত এই ফোবিয়াকে আরও শক্তিশালী হয়। অন্য কথায়, তাদের পরিস্থিতির প্রতি ভয়টি তখন সত্যিই প্রমাণিত হয় যখন তারা আসলেই অজ্ঞান হয়ে যান। তাই, এই ক্ষেত্রে রোগী একটি কৌশলও অনুশীলন করতে পারেন, যা ‘অ্যাপ্লাইড মাসল টেনশন’ নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট পেশি শক্ত করা হয়, যাতে ভ্যাসোভ্যাগাল প্রতিক্রিয়া কমে যায় এবং অচেতন ঘটনা প্রতিরোধ করা যায়।

তথ্যসূত্র: লাইভ সায়েন্স





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত