Homeদেশের গণমাধ্যমে১৬ বছর ধরে নষ্ট রেডিওথেরাপি যন্ত্র, চিকিৎসা পাচ্ছেন না রোগীরা

১৬ বছর ধরে নষ্ট রেডিওথেরাপি যন্ত্র, চিকিৎসা পাচ্ছেন না রোগীরা


রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যানসার চিকিৎসার একমাত্র যন্ত্রটি ১৬ বছর ধরে অচল হয়ে পড়ে আছে। ফলে রংপুরসহ বিভাগের আট জেলার রোগীদের চিকিৎসার জন্য ছুটতে হচ্ছে ঢাকায়। বছরের পর বছর ধরে হাসপাতালের রেডিওথেরাপি যন্ত্র অকেজো হয়ে পড়ে থাকায় ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে যন্ত্রটি সচল করার দাবি জানিয়েছেন রোগী ও স্বজনরা।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের কোবাল্ট টেলিথেরাপি যন্ত্রটি ২০০৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে নষ্ট হয়ে আছে। রেডিওথেরাপির মাধ্যমে ক্যানসার সেল (কোষ) ধ্বংস করার জন্য এই যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন গড়ে অর্ধশতাধিক ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। এ ছাড়া ২০ জনের বেশি রোগী অন্তর্বিভাগে ভর্তি থাকেন। তাদের মধ্যে অন্তত অর্ধেকের রেডিওথেরাপি দরকার হয়।

ক্যানসার বিভাগের চিকিৎসকরা বলছেন, বিভাগের কোনও হাসপাতালে ক্যানসারে আক্রান্তদের রেডিওথেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। এই হাসপাতালের যন্ত্রটি অচল থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন এই অঞ্চলের মানুষ। গত ১৬ বছর রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এতো বছরেও এটি চালু করার কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। এ কারণে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীরা রেডিওথেরাপি চিকিৎসা পাচ্ছেন না।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক গবেষণায় দেখা যায়, রংপুর বিভাগের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলা থেকে ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে স্তন ক্যানসারের রোগী ১৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ওভারি বা ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের রোগী ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ, গ্রুপ হিসেবে সবচেয়ে বেশি খাদ্যনালির ক্যানসারের রোগী ৩১ দশমিক ৯৪ শতাংশ ও শ্বাসতন্ত্রের ক্যানসারের রোগী ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসা জটিল হওয়ায় কারও ক্যানসার ধরা পড়ার পর রোগী ও স্বজনরা মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েন। ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য যেসব পরীক্ষা করা হয়, সেগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এরপর চিকিৎসা, সেটাও বেশ ব্যয়বহুল। যেকোনো ক্যানসারের জন্য চিকিৎসার তিনটি পদ্ধতি আছে—অপারেশন, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি। রেডিওথেরাপি ক্যানসারের একটি অন্যতম চিকিৎসাপদ্ধতি। রেডিওথেরাপি এককভাবে অথবা অপারেশন বা কেমোথেরাপির সঙ্গে যুক্তভাবে ব্যবহার করা হয়। যেসব ক্যানসারের জন্য রেডিওথেরাপি জরুরি, সেগুলো হলো মুখের ক্যানসার, গলার ক্যানসার, স্তন ক্যানসার, ব্রেনের ক্যানসার, জরায়ু ও জারায়ুমুখের ক্যানসার, মলদ্বারের ক্যানসার, ফুসফুসের ক্যানসার ও ত্বকের ক্যানসার।

৯ মাস আগে বিয়ে হয়েছিল নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার গাড়াগ্রাম গ্রামের আশরাফ আলীর মেয়ে রিক্তা বেগমের। দুই মাস পর গলায় ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর জমিজমা বিক্রি করে পাঁচবার কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। এখন রিক্তাকে রেডিওথেরাপি দেওয়া দরকার। এজন্য রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু হাসপাতালের একমাত্র রেডিওথেরাপি যন্ত্র বিকল থাকায় চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে। এখন হয় ঢাকায় যেতে হবে, না হয় অন্য কোনও সরকারি হাসপাতালে থেরাপি দিতে চার-পাঁচ মাস অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এক মাসের মধ্যে রেডিওথেরাপি না দিলে হয়তো তাকে বাঁচানো যাবে না বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় ঢাকায় কিংবা বেসরকারিভাবে থেরাপি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। 

রিক্তা বেগম বলেন, ‘রংপুরের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য একমাত্র ভরসা হলো ঢাকার জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। কিন্তু সেখানে চার থেকে ছয় মাসের আগে সিরিয়াল পাওয়া যায় না। আশপাশের কোনও হাসপাতালে মেশিন নেই। এ অবস্থায় মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছি আমি।’

হাসপাতালের রেডিওথেরাপি মেশিনটি অকেজো থাকায় চিকিৎসা না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন পীরগাছার আবেদ আলী ও লালমনিরহাটের আফজাল হোসেন। তারা জানিয়েছেন, রেডিওথেরাপি দিতে না পারায় হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় পড়ে আছেন তারা। অন্য কোথাও চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য নেই তাদের।

রংপুর হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার বনমালী রায় চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু রেডিওথেরাপি যন্ত্র অকেজো থাকায় তাকে থেরাপি দেওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে প্রতিদিন হাসপাতালে এসে রেডিওথেরাপি না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা।

বনমালী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে দুবার ঢাকায় গিয়ে রেডিওথেরাপি দিয়েছি। এখন আরও দুবার রেডিওথেরাপি লাগবে। কিন্তু অর্থের অভাবে আমার পক্ষে ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা করানো সম্ভব হচ্ছে না। আগে দুবার রেডিওথেরাপি নিতে জমিজমা বিক্রি করে দিয়েছি। এখন আর বিক্রির মতো কিছু নেই।’ 

রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট থাকায় চিকিৎসা পাচ্ছেন না উল্লেখ করে রংপুরের সরফ আলী ও দিনাজপুরের সাহাব উদ্দিন জানিয়েছেন, এটি আমাদের জন্য ভোগান্তির। ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা না পেয়ে অবহেলায় এভাবেই মারা যাচ্ছেন। তবু দায়িত্বশীলদের কোনও উদ্যোগ নিতে দেখছি আমরা। জরুরি ভিত্তিতে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেডিওথেরাপি মেশিন স্থাপনের দাবি জানাচ্ছি আমরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার নাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৯৯৭ সালে এই হাসপাতালে ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার জন্য রেডিওথেরাপির একটি যন্ত্র স্থাপন করা হয়। পরের চার বছর সেটি পড়ে ছিল। এ নিয়ে তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে ২০০১ সালে চালু করা হয়। এরপর থেকে রোগীদের চিকিৎসা চলছিল। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে যায়। তখন থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বহুবার বলেও কোনও কাজ হয়নি। যন্ত্রটি পাঁচ বছর পর পর চেকিং করার কথা থাকলেও ২০০৮ সালের পর তা করা হয়নি। ফলে এটি এখন আর কোনোভাবেই সচল করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় নতুন একটি রেডিওথেরাপি যন্ত্র জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে স্থাপন করতে হবে। না হয় অনেক রোগী রেডিওথেরাপি না পেয়ে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়বে।’

এ বিষয়ে রংপুরের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আক্কাছ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রংপুর বিভাগে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বিশেষ করে স্তন ক্যানসারের রোগী বেশি। তারা কোনও থেরাপি দিতে পারছেন না। বেশিরভাগ রোগীর আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। রংপুর মেডিক্যালে রেডিওথেরাপির যন্ত্র স্থাপন হলে রোগীদের চিকিৎসা পাওয়া সহজ হবে। এটি এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত