সংস্কার ও নির্বাচনকে যেভাবে মুখোমুখি করা হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
তিনি বলেন, যারা সংস্কার শেষ করার পর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন, তাদের উদ্দেশে বলতে চাই- যেটি শেষ হয়ে যায় সেটি সংস্কার নয়। কারণ, সংস্কার কখনো শেষ হয় না। সংস্কার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
শুক্রবার (২১ মার্চ) বিকেলে রাজধানীর ইস্কাটনের লেডিস ক্লাবে এক ইফতার মাহফিলে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তারেক রহমান এসব কথা বলেন। বিশিষ্ট নাগরিক ও পেশাজীবীদের সম্মানে বিএনপি এই ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, দেশের বর্তমান সংবিধান, যেটিকে ইচ্ছামতন কাটাছেঁড়া করে পতিত পলাতক স্বৈরাচার প্রায় তাদের দলীয় সংবিধানে পরিণত করে ফেলেছিল। সেই সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের ২ দফায় লেখা রয়েছে- জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জনপ্রতিনিধিদের জাতীয় সংসদ গঠিত হবে। সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকার পরেও পলাতক ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে, সারা বিশ্ব দেখেছে- বার বার জনগণের ভোট ছাড়াই গঠন করা হয়েছিল জাতীয় সংসদ। পলাতক স্বৈরাচার সংবিধান মানেনি।
তিনি বলেন, এই কারণে বিএনপি মনে করে- গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কেতাবি কিংবা পুঁথিগত সংস্কার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার এবং আচরণের ব্যবহারিক প্রয়োগ। জনগণের গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়ে কেবল সংস্কার টেকসই, সফল এবং কার্যকর হয়ে উঠতে পারে।
তারেক রহমান বলেন, দেশের বিশিষ্ট নাগরিকগণ তথা সুশীল সমাজ এবং পেশাজীবীদের ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। রাষ্ট্র এবং রাজনীতির ভালো-মন্দের অনেক কিছুই নির্ভর করে রাজনীতিবিদদের দেশপ্রেম ও রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির ওপর। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সমাজে বিশিষ্ট নাগরিক ও পেশাজীবীদের ভূমিকা যত বেশি কার্যকর থাকে, রাজনৈতিক সরকারও তত বেশি দায়িত্বশীল এবং শক্তিশালী হয়। রাজনীতিকে যদি একটি সুসংগঠিত-সুসংঘবদ্ধ ঘরের ছাদের সঙ্গে আমরা তুলনা করি, তাহলে খুব সম্ভবত সিভিল সোসাইটি এবং পেশাজীবীগণ হচ্ছেন সেই ঘরের খুঁটি বা পিলার। সুতরাং একটি রাষ্ট্রে রাজনীতিবিদ, সিভিল সোসাইটি এবং পেশাজীবীগণ একে অপরের পরিপূরক।
তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গৌণ ইস্যুকে মুখ্য ইস্যু বানাতে গিয়ে নিজেদের অজান্তে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের মধ্যে সংশয়-সন্দেহের জন্ম দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবারও বলতে চাই, সরকারের এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত হবে না, যাতে রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পায়। পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের হাতে এখনো রাষ্ট্র থেকে লুন্ঠন করা, জনগণের পকেট থেকে লুন্ঠন করা হাজার হাজার কোটি টাকা রয়ে গিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় এর আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ার অর্থ সারা দেশে ঘাপটি মেরে থাকা পলাতক স্বৈরাচারের দোসরদেরকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ দেড় দশকের মাফিয়া শাসনকালে তরুণ প্রজন্মের প্রায় সাড়ে তিন কোটি ভোটারসহ কেউ ভোট দিতে পারেনি। এসব ভোটারদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্যে সবার আগে প্রয়োজন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান। নাগরিকগণ রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী না হলে কোনো সংস্কারই কিন্তু টেকসই হবে না। এ সময় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা আজকে একটা অত্যন্ত কঠিন সময় অতিক্রম করছি। একটা ভয়াবহ ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাদেরকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে আজকে একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে এবং নতুন একটা গণতান্ত্রিক পার্লামেন্ট ও সরকার গঠিত হবে, সেই প্রত্যাশা নিয়ে গোটা জনগণ অপেক্ষা করছে। আমরা বিশ্বাস করি, এই সময়টা আমরা সবাই যে যেখানে আছি, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে আমাদের ভূমিকা আমরা পালন করব। আমরা যারা রাজনীতি করছি তারা, আমরা যারা বিভিন্ন পেশাতে আছি তারা, যারা বিভিন্নভাবে সরকার অথবা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত আাছি তারা সবাই এমনভাবে কথা বলব, কাজ করব- তা যেন গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে সুযোগ করে দেয়। এ সময় সংকট উত্তরণে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় ইফতার অনুষ্ঠানে সাংবাদিক শফিক রেহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, ব্যবসায়ী সালাহ উদ্দিন আলমগীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন, দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এমএ আজিজ ও সৈয়দ আবদাল আহমেদ বক্তব্য রাখেন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, কৃষিবিদ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিরা এই ইফতারে অংশ নেন। অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকত উল্লাহ বুলু, আবদুস সালাম পিন্টু, নিতাই রায় চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মনি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল হালিম, ইসমাইল জবিউল্লাহ, অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার, কেন্দ্রীয় নেতা রশিদুজ্জামান মিল্লাত, অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, কাদের গণি চৌধুরী, তাইফুল ইসলাম টিপুসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।