সে যা–ই হোক, ইতিহাসের এই বহুমাত্রিকতাই বলে দেয়, নির্মোহ ইতিহাস একটি অলীক কল্পনা। কারণ, মানুষ নিজেই রাজনৈতিক জীব এবং তার প্রতিটি চিন্তা ও কাজ রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাবের অধীন। অপর দিকে ঐতিহাসিক সত্য হলো লিখিত ইতিহাস, যা রচিত হয় বিজয়ীদের হাতে। তাই ইতিহাস কখনোই সম্পূর্ণ নির্মোহ বা বস্তুনিষ্ঠ হতে পারে না।
তবে ইতিহাসের এই বহুমাত্রিকতাকে অস্বীকার না করে এটিকে শিক্ষার মাধ্যমে একটি গঠনমূলক পথে ব্যবহার করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের শুধু নির্দিষ্ট সত্য শেখানোর পরিবর্তে তাদের ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো বিচার–বিশ্লেষণ করতে উৎসাহিত করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস শেখানোর সময় বিভিন্ন পক্ষের বয়ান তুলে ধরা গেলে, পাশাপাশি সে সময়কার জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরা গেলে শিক্ষার্থীরা শুধু অতীতের কৃতিত্ব নয়, সেই সময়কার জটিলতাও বুঝতে শিখবে।
এটি একদিকে যেমন তাদের দূর অতীতের ঘটনাবলির পারস্পরিক সম্পর্ক ও ধারাবাহিকতার আলোকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মূল্যায়ন করার সুযোগ দেবে, অপর দিকে তেমনি তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ও সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরও দায়িত্বশীল করে তুলবে।
নতুন বাংলাদেশে সংস্কার প্রয়াসের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের মূল জায়গা হলো ঐতিহাসিক সত্যের ওপর আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে প্রতীকী পুঁজির উৎস হিসেবে ইতিহাস বিনির্মাণ করে রাজনৈতিকভাবে নিজ দলের প্রতিষ্ঠার প্রবণতা। এক পক্ষ ইতিহাসকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে, আরেক পক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে জাতি হিসেবে বর্তমানের বহুধাবিভক্ত বাংলাদেশিদের জীবনে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মীয় মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিকতা ও রাজনৈতিক বিভাজনের প্রভাব আমাদের রাষ্ট্র সংস্কার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তোলে। শিক্ষা যদি বিভাজনের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে, তাহলে তা নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিভক্তি আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। কিন্তু একই শিক্ষা যদি ইতিহাসের বহুমাত্রিকতা ও সমন্বয় শিখতে সহায়তা করে, তাহলে রাষ্ট্রীয় আদর্শ ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’কে অঙ্গীকার করে আমরা জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হব।