শীতকাল মানেই উৎসবের মৌসুম। সেই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ স্ট্রিট ফুড। সারা বছর ঢাকার রাস্তায় স্ট্রিট ফুড পাওয়া গেলেও শীতের মৌসুমে এর চাহিদা ও বৈচিত্র্য বহুগুণ বেড়ে যায়। এসব খাবারের জনপ্রিয়তাই বলে দেয়— শীতকালীন স্ট্রিট ফুড এখন শুধু খাবার নয়, এটি এক ধরনের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে।
বাতাসে পিঠার ঘ্রাণ
শীত এলে ভাপা, চিতই, পাটিসাপটা কিংবা নকশি পিঠার মতো দেশীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যায় ঢাকার পথে পথে। সঙ্গে থাকে বাহারি ভর্তার সমাহার। বয়স্ক ব্যক্তি থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মের কাছে এগুলোর জনপ্রিয়তা সবসময়ই তুঙ্গে। বিশেষ করে শহরের ব্যস্ত কর্মজীবী মানুষের কাছে ফুটপাতে বসা পিঠার দোকানগুলো বেশ সুবিধাজনক। অল্প দামে ঘরোয়া স্বাদের খাবার খাওয়া এই শহুরে জীবনে এক বিশেষ আকর্ষণ।
ভাজাপোড়ার জনপ্রিয়তা
শীতকালে ভাজাপোড়া জাতীয় খাবারের প্রতি মানুষের ঝোঁক কিছুটা বেড়ে যায়। বিকাল বা সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে কিংবা অফিসগামী ব্যক্তিদের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে গরম গরম শিঙাড়া, সমুচা, পুরি, আলুর চপ খাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। এছাড়া চাহিদা বাড়ে চিকেন দিয়ে তৈরি বিভিন্ন আইটেমের। পাশাপাশি নানা ধরনের চটপটি-ফুচকাও শীতের সন্ধ্যায় ভোজনরসিকদের মন মাতিয়ে তোলে।
নতুন সংযোজন হাঁসের মাংস ভুনা ও রুটি
শীতের স্ট্রিট ফুডের তালিকায় যোগ হয়েছে হাঁসের মাংসের ভুনা ও রুটি। এই খাবারকে কেন্দ্র করে নগরীর ৩০০ ফিট সড়কে নীলা মার্কেটে যেন মেলা বসে! বিকাল হতেই সেখানে ভোজনরসিক মানুষেরা ভিড় জমাতে থাকেন। তাদের উপস্থিতিতে চারপাশে এক উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। দোকানগুলোতে গরম রুটি আর হাঁসের ঝাল মাংসের ভুনা বেশিরভাগ মানুষের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। শীতের সন্ধ্যা কিংবা রাতে এখানকার দোকানে গরম গরম খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতা অনেকের কাছেই অনন্য। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ফুটপাতে বসা ছোট ছোট স্থায়ী দোকানেও এখন হাঁসের মাংসের ভুনা ও রুটি পাওয়া যায়।
ঝাল-মিষ্টির মেলবন্ধন
শীতকালে ঝাল আর মিষ্টি স্বাদের খাবার যেন আলাদা আনন্দ দেয়। ঝালমুড়ি, চটপটির পাশাপাশি শীতকালে ঢাকার রাস্তায় মিষ্টি জাতীয় খাবারের চাহিদাও বেড়ে গেছে। গরম গরম জিলাপি, রসগোল্লা বা মালাই চপের দোকানগুলোতে দেখা যায় ক্রেতাদের ভিড়।
চা-কফির আড্ডা
শীতের সকালে কিংবা সন্ধ্যায় চা ও কফি যেন স্ট্রিট ফুডের অনুষঙ্গ। আদা চা, মালাই চা কিংবা দুধ চা শীতের আমেজ দ্বিগুণ করে তোলে। কিছু এলাকায় হাতে বানানো কফির ছোট ছোট স্টলও রয়েছে— যেখানে আড্ডা জমায় তরুণ-তরুণীরা।
ভোজনরসিকদের শীত মৌসুম
ভোজনরসিকদের জন্য শীত বাড়তি আনন্দ নিয়ে আসে বলেন জানান রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শীতের বিশেষ খাবার উপভোগ করতে আসা মানুষজন। বিগত কয়েক বছর ধরেই পরিবার ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে নীলা মার্কেটে হাঁসের ভুনা উপভোগ করতে আসেন আল-আমিন। তিনি বলেন, ‘শীত এলেই অপেক্ষায় থাকি কবে এখানে আসবো। এখানকার হাঁসের মাংসের ভুনা বেশ বিখ্যাত। শীতে কয়েকবার আসা হয়। কখনও পরিবারের সঙ্গে, কখনও বন্ধুদের নিয়ে।’
পান্থপথের মোড়ে পিঠার দোকানে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, শহরে বাসায় আয়োজন করে পিঠা বানানোর রীতি কম। কিন্তু শীত বাড়লেই সবার মাঝে পিঠা খাওয়ার ইচ্ছা জাগে। তাই এলাকার মোড়ে থাকা দোকান থেকে পিঠা কিনে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। যারা একা থাকেন শহরে তারা দোকানে দাঁড়িয়েই পিঠা উপভোগ করেন। ফাস্ট ফুডের বদলে অনেকে বন্ধুদের নিয়ে পিঠা খেতে পছন্দ করেন বলে জানান তারা।
তাদের মধ্যে সাদমান শাকিল নামে একজন বলেন, ‘দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, আর চিতই পিঠা খাচ্ছিলাম। শীত ছাড়া তো এই পিঠা পাওয়া যায় না। পেলেও স্বাদে পার্থক্য থাকে। নানা রকম ভর্তা দিয়ে পিঠা খাওয়ার আনন্দ শীতেই। অন্য সময় হলে হয়তো অন্যকিছু খেতাম।’
শীতে পিঠার চাহিদা থাকলেও স্থানভেদে ভাজাপোড়া ও কাবাবের চাহিদা রয়েছে বেশ। মিরপুর-১১ নম্বরে কাল্লুর চিকেন ও বিফ চাপ খেতে বিকাল থেকেই ভিড় করেন ভোজনবিলাসীরা। পরিবার নিয়ে আসা সুমাইয়া আক্তার বলেন, ‘শুক্রবার ইচ্ছে হয় বাইরে কিছু খাওয়া-দাওয়া করি। এছাড়া শীতে বাসার রান্নার ঝামেলা থেকেও মুক্তি মেলে। তাই বাইরে বের হই। শীতও উপভোগ করা যায়, আবার নানাপদের খাবারও খাওয়া হয়।’
পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের চ্যালেঞ্জ
যদিও স্ট্রিট ফুড শীতের সময় ঢাকার মানুষের কাছে অন্যতম আকর্ষণ, তবে এসব খাবারের মান এবং পরিবেশ নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন থাকে। সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে খাবার তৈরি না হওয়ায় কখনও কখনও খাদ্যজনিত অসুস্থতার ঝুঁকিও দেখা দেয়।
এ বিষয়ে নিউট্রিশন স্পেশালিস্ট সাদিয়া সুলতানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শীতের কনকনে ঠান্ডা বাতাসে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গরম গরম খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতা একদমই অনন্য। তবে সেইসঙ্গে খাবারের মান বজায় রাখা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকেও নজর দেওয়া জরুরি, যাতে এই খাবারগুলো মানুষের জন্য আনন্দদায়ক হয়।’