বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া দম্পতিদের শিশুসন্তানদের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত সম্পর্কে মামলাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে চলা ‘দুঃখ ও হতাশাজনক এবং ন্যায়নীতির পরিপন্থী’ আখ্যায়িত করে ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে পারিবারিক আদালতগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তবে এক শিক্ষিকার রিট আবেদনের সূত্র ধরে দেওয়া উচ্চ আদালতের সেই নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে। অন্য অনেক মামলা তো বটেই, হাইকোর্টে যাওয়া সেই শিক্ষিকার মামলাটির পরিণতিও ঝুলে আছে নির্দেশিত সময়সীমার প্রায় তিন বছর পরও। শিশুসন্তানদের অভিভাবকত্ব ও হেফাজতসংক্রান্ত মামলায় এভাবেই গড়িয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর।
উল্লিখিত শিক্ষিকা কাজ করেন রাজধানীর মিরপুরের একটি বেসরকারি স্কুলে। বনিবনা না হওয়ায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে স্বামীকে তালাক দেন। স্বামী তাঁদের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে চলে যান ঢাকার বাইরের একটি জেলায়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মেয়ের অভিভাবকত্ব দাবি করে ওই নারী ঢাকার পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। শুরু হয় আইনি প্রক্রিয়া। আদালত স্বামীকে হাজির হয়ে জবাব দিতে সমন জারি করেন। স্বামী দীর্ঘদিনেও আদালতে হাজির না হওয়ায় স্ত্রী হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। আবেদনে তিনি সন্তানের সঙ্গে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ করতে দেওয়ার সুযোগ এবং মা হিসেবে তার হেফাজতকারীর স্বীকৃতি দাবি করেন। তবে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর রিট আবেদনটি খারিজ করে দেন।
হাইকোর্টের এ-সংক্রান্ত আদেশে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে হাইকোর্ট বিভাগে বিবাহবিচ্ছেদসহ বিভিন্ন কারণে শিশুদের হেফাজত নিয়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হেবিয়াস কর্পাস (রিট) মামলা পরিচালনা করতে হচ্ছে। আদালত দেখেছেন, পারিবারিক আদালতগুলোতে শিশুর অভিভাবকত্ব ও হেফাজত সম্পর্কে মামলাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে চলছে। ২০১০, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মামলা এখনো বিচারাধীন উল্লেখ করে আদালত বলেন, শিশুদের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত সম্পর্কে মামলাগুলো এত দীর্ঘ সময় ধরে চলা দুঃখ ও হতাশাজনক এবং ন্যায়নীতির পরিপন্থী। এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। শিশুসন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত সম্পর্কিত মামলাগুলো যাতে দায়ের হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করা যায়, সে বিষয়ে পারিবারিক আদালতগুলোকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
ঢাকার ওই স্কুলের শিক্ষক নারীটির করা মামলাটি পারিবারিক আদালতকে ২০২২ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। মামলাটি চলছিল ঢাকার সিনিয়র সহকারী জজ দ্বিতীয় আদালত ও পারিবারিক আদালতে। মামলাটির বিভিন্ন আদেশ থেকে দেখা যায়, হাইকোর্টের আদেশ পৌঁছানোর পরও নির্দেশিত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে আবার বিবাদীপক্ষ হাইকোর্টে আবেদন করলে অন্য একটি বেঞ্চ ২০২২ সালের ১৫ মার্চ মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে দেন।
মামলা দায়েরকারী নারীর আইনজীবী সেঁজুতি ঘোষ আজকের পত্রিকাকে সম্প্রতি বলেন, ‘মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিসংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশ পারিবারিক আদালতে পৌঁছানোর পরও ‘প্রি-ট্রায়াল’-এর জন্য কয়েকটি তারিখ নির্ধারণ করেন আদালত। দ্রুত নিষ্পত্তির কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মামলার কার্যক্রম হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ স্থগিত করেছেন। তাই মামলার নিষ্পত্তি কবে হবে তা অজানা।’
সন্তানদের অভিভাবকত্ব ও হেফাজতসংক্রান্ত মামলার জটে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন যে বহুসংখ্যক অভিভাবক, এই শিক্ষিকা তাঁদেরই একজন।
রাজধানীর ভাটারা থানার শহীদ আজিজ সড়কের বাসিন্দা এক মা চার বছর বয়সী শিশুসন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত দাবি করে ঢাকার পারিবারিক আদালতে মামলা করেন ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি। এখন পঞ্চম অতিরিক্ত সরকারি জজ ও পারিবারিক আদালতে মামলাটি বিচারাধীন। বাদীর আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন জানান, মামলাটির নিষ্পত্তি এখনো হয়নি।
সন্তানকে নিজ হেফাজতে রাখার নির্দেশ চেয়ে ঢাকার অতিরিক্ত দ্বিতীয় সরকারি জজ ও পারিবারিক আদালতে ২০১৭ সালে মামলা করেন একটি শিশুর বাবা। লালবাগের বাসিন্দা ওই ব্যক্তির দাবি, স্ত্রীর কাছে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়। ৭ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। নথি থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর হাইকোর্ট এক আদেশে পারিবারিক আদালতকে ছয় মাসের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বাদীর আইনজীবী পলাশ বৈদ্য বলেন, ‘কারণে-অকারণে মামলার বিলম্ব হচ্ছে’।
ঢাকার ১৫তম পারিবারিক আদালতে বিচারাধীন এক মামলার বাদী ঢাকার মহাখালী ওয়্যারলেস গেট এলাকার এক নারী। স্বামী এক দিন দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি বরিশালের উজিরপুর চলে যান। দুই নাবালক সন্তানের অভিভাবকত্ব দাবি করে স্ত্রী মামলা করেন ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে। মামলার নথি থেকে দেখা যায়, স্বামী একবারও আদালতে হাজির হননি। আর তাই সমন জারিসংক্রান্ত প্রতিবেদনের জন্য বারবার দিন ধার্য করা হচ্ছে।
মামলার বাদী ওই নারী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তিন বছর ধরে আদালতে ঘুরছি। আইনজীবী বলেছেন, মামলা এখনো প্রস্তুত হয়নি।’
সংসদে সর্বশেষ আইনমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৪০ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন। সুপ্রিম কোর্টের গত বছরের হিসাব অনুযায়ী পারিবারিক মামলা বিচারাধীন ৬০ হাজার ৯২৫টি। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলা ৫ হাজার ৭৩৪টি। আর উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে ৯৫টি। এসবের মধ্যে দেনমোহরের দাবিতে করা মামলাও রয়েছে। সন্তানের হেফাজত বা অভিভাবকত্বের মামলা কতগুলো তা পৃথকভাবে হিসাব করা হয়নি। তবে কমপক্ষে ২০ হাজার মামলা চলমান রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ ও গার্ডিয়ান অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট, ১৮৯০-এ নাবালক শিশুসন্তানের অভিভাবকত্ব, তত্ত্বাবধান বা ভরণপোষণের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। এসব আইন ও বিধান অনুযায়ী, নাবালকের স্বাভাবিক ও আইনগত অভিভাবক বাবা হলেও বাবার অনুপস্থিতি কিংবা অযোগ্যতায় মা অভিভাবক হতে পারেন। আর নাবালক শিশুর সার্বিক কল্যাণ ও তত্ত্বাবধানে মায়ের অগ্রাধিকার রয়েছে। বিচ্ছেদ বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ছেলেসন্তানের ক্ষেত্রে সাত বছর বয়স ও মেয়েসন্তানের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত মায়ের জিম্মায় থাকার কথা। কিন্তু মামলা যদি বছরের পর বছর চলে, তাহলে শিশুসন্তানেরা মামলা শেষ হতে হতেই সাবালক হয়ে যায়। সে অবস্থায় আদালতে দায়ের করা মামলাগুলোর আর কোনো গুরুত্ব থাকে না। আবার অনেক মামলা পারিবারিক আদালতে নিষ্পত্তি হওয়ার পরও জেলা জজ আদালত, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়ায়। নাবালক শিশু সাবালক হওয়ার পর আইনত নিজেই নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
সমাজবিজ্ঞানী ও শিশু মনোবিদেরা বলে থাকেন, হেফাজত নিয়ে মা-বাবার আইনি লড়াই শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মামলা দীর্ঘায়িত হলে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিও বেশি হয়। বিচ্ছিন্ন মা-বাবার মামলার জালে পড়ে নাবালক সন্তানদের সম্ভাবনা নষ্ট হওয়া সমাজে এখন পরিচিত চিত্র।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নির্দেশ অনুযায়ী ৬ মাসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না করা হাইকোর্টের আদেশের লঙ্ঘন।’
সালমা আলী বলেন, ‘এসব মামলার বিবাদীদের নামে সমন ইস্যু করতে হয়। অনেক সময় সমন যথাযথভাবে জারি হয় না। এ কারণেও মামলার নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে।’
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ আহমেদ গাজী বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশ মেনে সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য পারিবারিক আদালতের চেষ্টা থাকতে হবে। এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এটি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।’
আরেকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, ‘হাইকোর্ট কোনো আদেশ দিলে নিম্ন আদালত তা মানতে বাধ্য। না মানলে সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদও লঙ্ঘন করা হয়। পারিবারিক মামলার ক্ষেত্রে বিবাদী পক্ষের নামে সমন যথাযথভাবে জারি হচ্ছে না। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সমন জারি নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া আদালত প্রশাসনকে খুঁজে বের করতে হবে।’