Homeজাতীয়পথে নামতে মনে ভয়

পথে নামতে মনে ভয়


আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য যৌথ বাহিনীর ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলাকালে বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই, ডাকাতি, সড়কে ডাকাতি, গুলি, হামলা, ধর্ষণের ঘটনায় আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ। পুলিশের টহল তেমন না থাকায় সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বাইরে বের হতে ভাবতে হচ্ছে মানুষকে। সারা দেশেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।

‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’-এর ব্যানারে শিক্ষার্থীরা গতকাল আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলার অবনতির বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও অস্বীকার করছেন না। তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এ জন্য দায়ী করেছেন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগীদের। বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোর কমিটির সভা শেষে তিনি বলেছেন, আইনশৃঙ্খলার উন্নতিতে গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন তিনি।

ডাকাতি ও ছিনতাই রোধে পুলিশের তিনটি বিশেষায়িত ইউনিট শিগগির মাঠে নামছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। তিনি বলেছেন, ডিএমপি, র‍্যাব ও অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট যৌথ অভিযান চালাবে, যা রাত থেকে বাস্তবায়ন হবে।

পুলিশের পুরোদমে সক্রিয় না হওয়ার সুযোগে কয়েক মাস ধরেই ছিনতাই, ডাকাতি, গুলি, হামলার ঘটনা বেড়েছে। রাজধানীর উত্তরায় এক দম্পতিকে কোপানোর ও টাঙ্গাইলে বাসে ডাকাতি-শ্লীলতাহানির ঘটনার রেশ না কাটতেই গত রোববার রাতে ঢাকা শহরে একাধিক জায়গায় গুলি করে ছিনতাই ও ডাকাতি হয়েছে। বনশ্রী ডি ব্লকে রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে আনোয়ার হোসেন নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে ২০০ ভরি সোনা ও ১ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। তাঁর দুই ঊরুতে দুটি ও পাশে একটি গুলি লাগে। তাঁর হাত, পা ও ঊরুতে কোপানো হয়। মোবাইলে ধারণ করা এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। শেয়ার হতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকে।

ছবি: আজকের পত্রিকা

ছবি: আজকের পত্রিকা

বনশ্রীর ওই ঘটনার কিছু আগে ধানমন্ডির শংকরে ১০-১২ জন যুবক দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ডাকাতির জন্য মহড়া দেয়। এতে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় মসজিদের মাইকে মহল্লায় ডাকাত দল প্রবেশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়।

শনিবার রাতে নওগাঁর পত্নীতলায় সড়কে গাছ ফেলে একটি বাস ও একটি মাইক্রোবাসে ডাকাতি হয়। একই রাতে ঢাকার আশুলিয়ার জিরানী নিজ বাসায় ডাকাতের গুলিতে আহত হন অভিনেতা আজিজুর রহমান আজাদ। ডাকাতিতে বাধা দেওয়ায় তাঁর পায়ে তিনটি গুলি করা হয়। তাঁর মা ও স্ত্রীও আহত হন।

শুক্রবার ঝিনাইদহে তিনজনের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় দায় স্বীকার করে একটি লিফলেটে লেখা ছিল ‘কালু, জাসদ গণবাহিনী’।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন অবনতিতে সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে বলে জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। রাজশাহীতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘টাকা থাকলে, বদ মতলব থাকলে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট করার মতো অনেক কিছু করা যায়। আমাদের ব্যর্থতা আছে, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।’

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ধানমন্ডির একাংশ ও মোহাম্মদপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বেশি অবনতি হয়। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ও বেসরকারি চাকরিজীবী এনামুল হোসেন বলেন, মোহাম্মদপুরের কিছু এলাকায় ছিনতাইকারীদের এত দৌরাত্ম্য যে দিনের বেলায়ও যাওয়া যায় না। তিনি ছিনতাইয়ের ভয়ে অফিস ছুটির সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে দ্রুত বাসায় চলে আসেন।

রাজধানীর আরও অনেক এলাকায় বেড়েছে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য। কেবল নীরব সড়কে নয়, যানজটে আটকে থাকা যানবাহনেও হচ্ছে ছিনতাই। যাত্রাবাড়ীর কাজলা পেট্রলপাম্প এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রাতে জটে আটকে পড়া যানবাহনের যাত্রী-চালক মাঝেমধ্যে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছেন। পথচারীরাও বাদ যাচ্ছেন না।

১৭ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী একটি বাস টাঙ্গাইলে পৌঁছালে যাত্রীবেশী ডাকাতেরা বাসটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা তারা বাসটি নিয়ন্ত্রণে রেখে যাত্রীদের টাকা, স্বর্ণালংকার, মালামাল লুট করে। নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানি করে। ধর্ষণের অভিযোগও শোনা গেছে। এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি, তবে শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জানুয়ারিতে সারা দেশে ৭১টি ডাকাতি, ১৭১টি ছিনতাই, ২৯৪টি খুন, ১০৫টি অপহরণের মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ঘটেছে ৮টি ডাকাতি, ৫৪টি ছিনতাই, ৩৬টি খুন ও ৩১টি অপহরণ। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অপরাধের সংখ্যা পরিসংখ্যানের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।

আইনশৃঙ্খলার এই পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে রোববার গভীর রাতে বিক্ষোভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হয়ে তাঁরা বিভিন্ন স্লোগান দেন।

এর পর রাত ৩টায় বারিধারায় নিজ বাসভবনে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগের দোসররা। তাদের হাতে প্রচুর টাকা রয়েছে। সেসব টাকা দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে। কিন্তু সেই সুযোগ তারা পাবে না। তাদের সবার ঘুম হারাম করে দেব।’ নিজের পদত্যাগের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা চায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হোক। সেটাই করার চেষ্টা করছি। সফল হলে পদত্যাগের প্রসঙ্গ আসবে না।’

দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, এমন পরিস্থিতির নেপথ্য কারণ পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তদের একটি বড় অংশ পুলিশ বাহিনীতে রয়েছে। তাদের গা-ছাড়া ভাব রয়েছে। এ ছাড়া ওই সময়ে পুলিশে সুবিধাভোগীদের একটি অংশও আছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ অনেক অপরাধী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। পুলিশের যথাযথ টহল, নজরদারি, সক্রিয়তা না থাকার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা।

পুলিশ-র‍্যাবের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠে কাজ করছে সেনাবাহিনী। গতকাল সাভার সেনানিবাসে ফায়ারিং প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, মাঝে মাঝে কাজ করতে গিয়ে কিছু বলপ্রয়োগ হয়ে যায়। বল প্রয়োগ করতে গেলেও অত্যন্ত পেশাদারত্বের সঙ্গে যেন হয় এবং যত কম বল প্রয়োগ করা যায়, ততই ভালো।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘অপরাধীদের দৌরাত্ম্য যতটা বাড়ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা এর চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। যে কারণে পরিস্থিতি আর উন্নতি হচ্ছে না।’





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত