শেখ হাসিনার পতন ঘটানো জুলাই আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে। এই আন্দোলনে প্রথম হামলা ও নিপীড়নের শুরুটাও হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। আন্দোলনকারীদের ওপর এসব হামলায় জড়িত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পাশাপাশি হামলায় উসকানি দেওয়া শিক্ষকেরাও শাস্তি পেতে যাচ্ছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে চার শ শিক্ষার্থী ও নয়জন শিক্ষককে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৮, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮৯ এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ১৯ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
শুধু এই তিন বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হামলার ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে। এসব ঘটনাকে আমলে নিয়ে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জুলাইয়ে আন্দোলন চলাকালে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এতে নেতৃত্ব দেয় তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। এসব ঘটনার বিচার না হলে দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দীর্ঘায়িত হবে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জানান, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এসব হামলার ঘটনা বিচারের মুখোমুখি করতেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাবি সূত্রে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১২৮ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। ১৭ মার্চ সিন্ডিকেটের এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংঘটিত বেআইনি ও সহিংস ঘটনার অধিকতর তদন্তের জন্য সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. তাজমেরী এস এ ইসলামকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘এ কমিটি সত্যানুসন্ধান কমিটি কর্তৃক চিহ্নিত ১২৮ জনের বিষয়টি আমলে নিয়ে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে সহিংস ঘটনায় জড়িতদের তথ্য চেয়ে চিঠি দেবে। প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে শিগগিরই তদন্ত কমিটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ করবে। পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
সত্যানুসন্ধান কমিটি কর্তৃক চিহ্নিত ১২৮ জনের তালিকাটি পূর্ণাঙ্গ নয় বলেও এ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। এ নিয়ে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুন্সী শামসউদ্দীন আহমেদ বলেন, ১২৮ জনকে প্রাথমিকভাবে সাময়িক বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বহিষ্কারের নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি।
একইভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও জুলাই আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় ২৮৯ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কারসহ তিন রকম শাস্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হামলার ঘটনায় মদদ দেওয়ার অভিযোগে নয়জন শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে জাবি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগের ২৮৯ নেতা-কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তিন ক্যাটাগরিতে তাদের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। যাদের ছাত্রত্ব শেষ, তাদের সনদ স্থগিত করা হবে, যারা পরীক্ষা ও ভাইভা দিয়েছে, তাদের ফলাফল স্থগিত করা হবে এবং নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সাময়িক বহিষ্কার করা হবে।
জুলাই আন্দোলনে হামলার ঘটনায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও (চুয়েট) মোট ১৯ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে সাত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম এবং স্থায়ীভাবে আবাসিক হল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর বাইরে কেবল আবাসিক হল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে আরও ১২ শিক্ষার্থীকে।
জানতে চাইলে চুয়েটের ছাত্রকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মাহবুবুল আলম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থবিরোধী এবং ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলাপরিপন্থী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের কারণ দর্শাতে বলা হয়। তাদের জবাব এবং অভিযোগের বিপরীতে পাওয়া তথ্য-প্রমাণের আলোকে শৃঙ্খলা কমিটি এসব শাস্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন জুলাইয়ে তীব্র আকার ধারণ করে। পরে তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার তুমুল সেই আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে এই আন্দোলনে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পরে জুলাই-আগস্টে সরকার পতন আন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। এ বিচার কার্যক্রম এখন পুরোদমে চলছে। এসবের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও জুলাইয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করল।
সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়। ওই সময় (জুলাই-আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে, তার বিচার সে বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব আইন অনুযায়ী করবে।