গত মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে দেশের শিল্পকলকারখানার পাইকারি গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে পেট্রোবাংলা। এরপর খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাসসহ দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থা গ্যাসের দাম বাড়ানোর আবেদন করে। এতে শিল্পের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা এবং শিল্পে ব্যবহৃত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বা ক্যাপটিভের গ্যাসের দাম ৩১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করে তারা। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) মিলনায়তনে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে উন্মুক্ত গণশুনানির আয়োজন করেছে বিইআরসি। শিল্প খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গ্যাস বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাব অনুযায়ী ১০০ শতাংশের বেশি দাম বাড়লে আগে থেকে চাপা থাকা অর্থনীতি আরও সংকটে পড়বে। রপ্তানি আয়ের ওপর পড়তে পারে প্রভাব। এ ছাড়া দেশের ভেতর পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, যা শেষ পর্যন্ত সাধারণ ভোক্তার পকেট কাটবে।
বিইআরসি সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে পেট্রোবাংলার পাইকারি গ্যাসের ওপর গণশুনানি করা হবে। এরপর তিতাস গ্যাস, কুমিল্লা অঞ্চলের বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, সিলেট বিভাগের জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও বগুড়ার পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড, চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড কোম্পানির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হবে। তবে প্রতিটি কোম্পানিই গ্যাসের দাম বাড়ানোর অভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে। তবে এবার বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত চুলার গ্যাসের দাম বাড়ছে না। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানোরও প্রস্তাবে রাখা হয়নি।
এর আগে গ্যাসের সংকট সমাধান করে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে দুই বছর আগে শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। দাম বাড়লেও গ্যাসের সংকট কাটেনি। শিল্প এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপের অভিযোগ শিল্পমালিকদের। এ ছাড়া বাসাবাড়িতে গ্যাস মেলে না এ অভিযোগ তো রয়েছেই।
এবারও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে যুক্তি দেখানো হয়েছে, যদি গ্যাসের দাম না বাড়ানো হয়, তাহলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করতে গিয়ে চলতি বছরে সরকারের ভর্তুকি দিতে হবে ২২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।
এলএনজির চাপেই বাড়ছে লোকসান: পেট্রোবাংলা দেশে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ করে ২৫০ কোটি ঘনফুট থেকে ২৭০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে বিদেশ থেকে আনা এলএনজি দৈনিক সরবরাহ করা হয় মোট গ্যাসের ২৫ শতাংশ। যদিও দৈনিক সর্বোচ্চ ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে দেশে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের।
পেট্রোবাংলা তাদের প্রস্তাবে বলেছে, গত জানুয়ারি থেকে আগামী জুন পর্যন্ত ১০১টি এলএনজি কার্গো আমদানি করলে বিদ্যমান দামে লোকসান যাবে ১৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। আর চলতি ২০২৫ সালে ১১৫টি এলএনজি কার্গো আমদানি করলে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াবে ২২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ওই বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড় এলএনজি আমদানির খরচ প্রতি ঘন মিটারে পড়েছে ৬৩ টাকা ৫৮ পয়সা। এর সঙ্গে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ৯ টাকা ৮৮ পয়সাসহ আটটি বিভিন্ন পর্যায়ের মার্জিন ও তহবিল যোগ করলে প্রতি ঘনমিটার এলএনজির আমদানির ব্যয় পড়েছে ওই তিন মাসে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা। গত বছরের জুলাই থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত এলএনজি আমদানি করতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। আগামী জুন পর্যন্ত ব্যয় হবে আরও ১৯ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি যা কেনা হচ্ছে, তার দাম পড়ছে গড়ে সাড়ে ১০ ডলার। অন্যদিকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা হচ্ছে গড়ে ১৩ থেকে প্রায় ১৪ ডলার দামে। অক্টোবর থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত স্পট এলএনজি কেনা হয়েছে ১৪ কার্গো। একই সময় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে কেনা হয়েছে ১৮ কার্গো এলএনজি। যখন এলএনজির দাম বেড়ে যায় তখন দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ছুতোয় এলএনজি সরবরাহ কমিয়ে দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডলারের রিজার্ভে খরা চলছে। এই অবস্থার মধ্যেও জরুরি জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত রাখতে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে বছরে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। এই ব্যয় ওঠাতে সরকার গ্যাসের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছে, যা চাপে থাকা শিল্পকলকারখানার উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেবে, পণ্যের দাম বাড়বে। এতে জনসাধারণের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। দেশীয় গ্যাস উত্তোলনের পরিকল্পনা বড় আকারে না নিলে এলএনজির ওপর নির্ভরতা কমবে না বলেও তাঁদের মত। এতে দেশের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে গ্যাসের দাম।
প্রস্তাবেও ফাঁকি আছে: পেট্রোবাংলা দাবি করেছে যে তারা চলতি বছরের ১১৫টি কার্গো এলএনজি কিনবে, এতে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াবে ২২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। এই প্রাক্কলন অতিরিক্ত বলে মনে করেন খোদ পেট্রোবাংলার দুই কর্মকর্তা। তাঁরা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়াতে এলএনজিকে অজুহাত হিসেবে দেখানো হয়। পেট্রোবাংলা কখনোই ১১৫টি এলএনজি কার্গো আমদানি করবে না। কিন্তু গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময় এলএনজির যে কল্পিত প্রাক্কলন করা হয়, তার হিসাবেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। বাস্তবে ওই পরিমাণ এলএনজি আমদানি করা হয় না।
দুই কর্মকর্তা বলছেন, ২০১৯ সালে দৈনিক ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের কথা বলে দাম বাড়ানো হয়, অথচ এসেছিল দৈনিক ৫৬ কোটি ঘনফুট। ২০২২ সালে দৈনিক ৬৯ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও দৈনিক আসে ৬৫ কোটি ঘনফুট। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয় সরকারের নির্বাহী আদেশে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের নিজেদের গ্যাস রয়েছে। এই গ্যাস উত্তোলনের বড় কোনো পরিকল্পনা নেই। আগের সরকার এলএনজি বিশেষত স্পট মার্কেটের এলএনজি কেনায় বেশি আগ্রহ ছিল, এই সরকারও তা-ই করছে। জ্বালানি নিরাপত্তা সংহত করতে হলে দেশি গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে হবে।’