Homeঅর্থনীতিছাঁটাই নিয়ে টেলিকম খাতে অস্থিরতা

ছাঁটাই নিয়ে টেলিকম খাতে অস্থিরতা


দেশের টেলিকম খাতের কাজের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, ছাঁটাই ও চাকরিচ্যুতির ঘটনায় খাতজুড়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। চাকরি স্থায়ী ও বকেয়া পাওনা পরিশোধসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন দেশের বৃহৎ তিন টেলিকম প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের সঙ্গে যুক্ত কয়েক শ আউটসোর্সিং-কর্মী। কর্মী ছাঁটাই বন্ধ এবং চাকরি স্থায়ী না করলে দেশের মোবাইল ফোনসেবা বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন তাঁরা। এতে যেকোনো সময় টেলিযোগাযোগ সেবায় বিপর্যয় নামতে পারে বলে আশঙ্কা করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং আইন- শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোকে আন্দোলনরত কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে সংকট সমাধানের নির্দেশ দিয়েছেন।

জানা গেছে, মূলত তৃতীয় পক্ষ বা থার্ড পার্টির হয়ে টেলিকম খাতের কাজে নিযুক্ত কর্মীরাই এসব দাবিতে এক হয়েছেন। বছরের পর বছর অস্থায়ী চুক্তিতে কাজ করানো হচ্ছে বলে অভিযোগ এনে এর সমাধানের জন্য আন্দোলন করছেন তাঁরা।

দেশের প্রতিটি মোবাইল ফোন কোম্পানি তাদের টাওয়ার ও সাইট রক্ষণাবেক্ষণ এবং দেখভালের জন্য তৃতীয় পক্ষ বা থার্ড পার্টি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে বা ইজারা দিয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠান চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ দিয়ে সেবা পরিচালনা করে। তারা অস্থায়ী ভিত্তিতে ও চুক্তিতে প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেয়। এই প্রক্রিয়ায় শত শত কর্মী চুক্তিতে কাজ করে মোবাইল ফোনসেবা অব্যাহত রাখেন। তবে থার্ড পার্টি এসব কর্মীর সঙ্গে মজুরি পাওনা ও ভাতা নিয়ে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা করে বলে অভিযোগ তাঁদের।

টেলিকম সেবা প্রতিষ্ঠান বাংলালিংক তাদের টাওয়ার রক্ষণাবেক্ষণসহ ফিল্ড অপারেশনের জন্য ফ্রন্টডেস্ক বাংলাদেশ লিমিটেড, সার্চলাইট কমিউনিকেশন লিমিটেড ও আইএমএস লিমিটেড নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী নিয়ে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে তিন মাস বা নব্বই দিন করে চুক্তি করে বাংলালিংককে সেবা দেয়। এসব কর্মী দেশব্যাপী বাংলালিংকের টাওয়ার রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করেন। তবে গত ২৬ জানুয়ারি ও ২ ফেব্রুয়ারি এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ১৩২ জনকে পূর্বঘোষণা ছাড়াই চাকরিচ্যুত করার নোটিশ দেওয়া হয়।

চাকরিচ্যুত কর্মীদের একজন প্রকৌশলী মানিক উদ্দিন বলেন, ফ্রন্টডেস্ক লিমিটেড কর্তৃপক্ষ কোনো ঘোষণা ছাড়াই মার্চ থেকে সবাইকে চাকরিচ্যুত করার নোটিশ দিয়েছে মেইলে। রোজার ঈদের আগেই এভাবে চাকরিচ্যুত করাটা আইনবিরোধী। শ্রম আইন ও বিধিমালা অনুসারে যেসব সুবিধা তাঁদের পাওয়ার কথা, তা তাঁরা পাননি। নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর শ্রম আইন ও বিধিমালা লঙ্ঘন করে আসছে।

চাকরিচ্যুতির নোটিশ পাওয়ার পর প্রতিকার চেয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের কাছে চিঠি লেখেন ১৩০ প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ান।

ফ্রন্টডেস্ক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে বাংলালিংকে নিয়োগ পাওয়া প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান শিকদার বলেন, প্রতিকার চেয়ে আমরা বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছি। এ ছাড়া নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানেও চিঠি লিখেছি।

জানতে চাইলে ফ্রন্টডেস্ক বাংলাদেশ লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ শামীম আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, চাকরিচ্যুতদের বিষয়টি অফিশিয়াল একটি প্রক্রিয়া ছিল। তাই তাঁদের চাকরিচ্যুতির নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তবে তাঁদের চাকরিতে পুনরায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলালিংকের একটি নির্দেশনা আছে। সে জন্য কাজ চলছে।

এদিকে চাকরিচ্যুতির নোটিশ পাওয়া রাজধানীসহ ১৬ জেলার কর্মীরা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে ১১ ফেব্রুয়ারি দেখা করেন। তাঁর কাছে নিজেদের অভিযোগের কথা জানান। উপদেষ্টা তাঁদের আশ্বস্ত করেন। এভাবে সরকারের বিভিন্ন মহলে চাকরিচ্যুতরা চিঠি দেওয়ার পর নড়েচড়ে বসে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন তৌহিদ আহমেদ বলেন, কর্মীদের চাকরিচ্যুত করার বিষয়টি তাঁদের জানা নেই।

আরেক বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর রবি নিজেদের নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইডটকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড, পিপলস্কেপ লিমিটেড, ই-জোন লিমিটেড এবং এইচএস ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামের চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী আউটসোর্সিং করে থাকে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান ১২ ফেব্রুয়ারি একযোগে ২২০ জনকে চাকরিচ্যুত করে। তাঁরা সবাই ১২ থেকে ১৪ বছর ইডটকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের হয়ে রবির ফিল্ড অপারেশনের কাজ করতেন। এক যুগ আগে নিয়োগের সময় তাঁদের সঙ্গে কেবল ৯০ দিনের লিখিত চুক্তি করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে এরপর আর চুক্তি নবায়ন করা হয়নি। মৌখিক চুক্তিতেই কাজ করছিলেন তাঁরা।

জানা গেছে, ইডটকো এসব কর্মীকে নিয়োগ দিলেও এরপর অপর তিনটি প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে তাঁদের ভাগ করে দেয়। তাঁদের মজুরিও পরিশোধ করত ওই তিন প্রতিষ্ঠান। মূলত কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য এই কৌশলী অবস্থান নেয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

ইডটকোর হয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার পর সম্প্রতি চাকরিচ্যুত হয়েছেন প্রকৌশলী (রিজিওনাল অপারেশনাল ম্যানেজমেন্ট) আল আমিন বিদ্যুৎ। তিনি জানান, এক যুগ আগে পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি ইডটকোতে নিয়োগ পান। এরপর থেকেই রবির নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করছেন। নিয়োগের সময় একবার ইডটকো তিন মাসের জন্য তাঁর সঙ্গে চুক্তি করেছিল। এরপর আর কোনো চুক্তি করেনি। মৌখিক চুক্তিতে কাজ করছেন এক যুগ ধরে। নিয়োগ ইডটকোর হলেও তাঁকে পিপলস্কেপের হয়ে কাজ করতে হচ্ছে, তারাই বেতন দিচ্ছে। তবে কোনো কারণ ছাড়াই ১২ ফেব্রুয়ারি পিপলস্কেপ একটি গণপদত্যাগপত্রে তাঁদের সবাইকে স্বাক্ষর করতে বলেছে।

রবির নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা এমন ২২০ জনকে সম্প্রতি চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাঁদের চাকরি রয়েছে। চাকরিচ্যুতরা ইতিমধ্যে প্রতিকার চেয়ে বিটিআরসির মেজর জেনারেল মো. এমদাদ উল বারীর কাছে একটি আবেদন দিয়েছেন। এ ছাড়াও তাঁরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনি নোটিশ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে পিপলস্কেপের মানবসম্পদ বিভাগের এক্সিকিউটিভ সৈয়দ আলী আহসান বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান ১২০ জনকে চাকরিচ্যুত করেছে। তিন মাস পরপর চুক্তি করার কথা থাকলেও তিনি গত সাত মাসে চুক্তি করতে দেখেননি।

আউটসোর্সিং-কর্মীদের চাকরিচ্যুতির বিষয়ে রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, বিটিআরসির অন্যতম লাইসেন্সপ্রাপ্ত টাওয়ার ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইডটকোর কাছে দীর্ঘমেয়াদি ইজারার মাধ্যমে রবি টেলিযোগাযোগ সেবা দেন। রবি টাওয়ার কোম্পানিগুলোর সহায়তায় তারা নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করে চলেছে।

বাংলালিংক ও রবি ছাড়া গ্রামীণেও চলছে অস্থিরতা। ‘চাকরিচ্যুত ও অধিকারবঞ্চিত গ্রামীণফোন শ্রমিক ঐক্য পরিষদ’-এর ব্যানারে কয়েক শ কর্মী আন্দোলন করছেন। আন্দোলনকারীরা বলছেন, ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে ৩ হাজার ৩৬০ কর্মীকে অবৈধভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ৫ শতাংশ লভ্যাংশ পরিশোধের দাবি তুলে ধরেন চাকরিচ্যুত কর্মীরা।

চাকরিচ্যুত ও অধিকারবঞ্চিত গ্রামীণফোন শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আবু সাদাত মো. শোয়েব বলেন, ৫ শতাংশ লভ্যাংশ না দিলে ২৫ তারিখ থেকে গুলশানের জিপি হাউসের সামনে তিন হাজার কর্মী অবস্থান কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দিয়েছেন।

এ বিষয়ে গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশনস আতঙ্কিত সুরেকা বলেন, এই নিয়ে আদালতে মামলা চলমান। মামলায় যে সিদ্ধান্ত হবে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত