কয়েক মাস ধরে ব্যবসায় সম্প্রসারণের ধারা অব্যাহত থাকলেও এর গতি স্থিতিশীল নয়। গত বছর জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে অর্থনীতি সংকোচনের মুখে পড়েছিল, যা পরবর্তী মাসগুলোতে পুনরুদ্ধারের পথে ফিরে আসে। অক্টোবরে শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের পর নভেম্বরে গতি আরও বাড়লেও ডিসেম্বরে তা কিছুটা শ্লথ হয়ে যায়। জানুয়ারিতে গতি বাড়লেও ফেব্রুয়ারিতে তা আবার কমেছে। অর্থাৎ অর্থনীতি সম্প্রসারণের ধারা অব্যাহত থাকলেও বাড়ন্তের গতি আগের তুলনায় কিছুটা কমে গেছে। এতে ব্যবসা, বিনিয়োগ ও উৎপাদনে একটু ধীর প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, যাতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কারণে ব্যবসায়ীদের আস্থাও কিছুটা কমেছে।
গতকাল রোববার মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স (এমসিসিআই) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ পারচেজিং ম্যানেজার্স’ ইনডেক্স (পিএমআই) সূচকের সর্বশেষ তথ্যও এই প্রবণতাকে ইঙ্গিত করছে। ফেব্রুয়ারি মাসে সামগ্রিক স্কোর জানুয়ারির তুলনায় ১.১ পয়েন্ট কমে ৬৪.৬-এ নেমেছে, যা সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে দেশের সামগ্রিক পিএমআই স্কোর দাঁড়িয়েছে ৬৪ দশমিক ৬, যা জানুয়ারির তুলনায় ১ দশমিক ১ পয়েন্ট কম। এই সর্বশেষ পিএমআই সূচক নির্মাণ ও সেবা খাতে ধীর সম্প্রসারণ হার এবং কৃষি ও উৎপাদন খাতে দ্রুত সম্প্রসারণ হারের কারণে হয়েছে।
পিএমআই শূন্য থেকে ১০০ নম্বরের মধ্যে পরিমাপ করা হয়। সূচকের মান ৫০-এর বেশি হলে অর্থনীতির সম্প্রসারণ এবং ৫০-এর নিচে হলে সংকোচন বোঝায়। আর মান ৫০ থাকলে বুঝতে হবে সংশ্লিষ্ট খাতে ওই মাসে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
গত জুলাইয়ে এক ধাক্কায় পিএমআই মান ৩৬ দশমিক ৯ পয়েন্টে নেমে এসেছিল। আগস্টে তা কিছুটা বেড়ে ৪৯ দশমিক ৭ পয়েন্ট হয়। আর অক্টোবরে এসে ৫৫ দশমিক ৭ পয়েন্টে ওঠে।
ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের শতবর্ষের পুরোনো সংগঠন এমসিসিআই ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ এক বছর ধরে যৌথভাবে পিএমআই প্রণয়ন করছে। সূচকটি প্রণয়নে সহযোগিতা করছে যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কার্যালয় (এফসিডিও) ও সিঙ্গাপুর ইনস্টিটিউট অব পারচেজিং অ্যান্ড ম্যাটেরিয়ালস ম্যানেজমেন্ট (এসআইপিএমএম)।
পলিসি এক্সচেঞ্জ চেয়ারম্যান ও সিইও, এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘বাংলাদেশের পিএমআই সূচক টানা পাঁচ মাসের স্থায়ী সম্প্রসারণ নির্দেশ করে, যা রপ্তানি বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা এবং কৃষিতে মৌসুমি প্রবৃদ্ধি দ্বারা চালিত হয়েছে। তবে নির্মাণ এবং সেবা খাতে ধীর সম্প্রসারণ দেখা গেছে। দুর্বল চাহিদা, জ্বালানি-বিভ্রাট এবং চলমান বিক্ষোভের কারণে ব্যবসায়িক আস্থা কম। টেকসই পুনরুদ্ধার আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং অগ্রাধিকারমূলক সংস্কারের দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করে।
সূচক পরিমাপে চারটি খাত বিবেচনায় নেওয়া হয়। সেই চারটি খাত হলো উৎপাদন, কৃষি, নির্মাণ ও সেবা। তার মধ্যে জানুয়ারিতে পণ্য উৎপাদন গতি কমলেও কৃষি, ব্যবসা, নির্মাণ ও সেবা খাতের ব্যবসা সম্প্রসারণে গতি কিছুটা বেড়েছে। তাতে সামগ্রিকভাবে পিএমআই মানও বেড়েছে ৪ পয়েন্ট।
পিএমআই প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃষি খাত টানা পাঁচ মাসের সম্প্রসারণ বজায় রেখেছে এবং দ্রুত সম্প্রসারণ হার প্রদর্শন করেছে। নতুন ব্যবসা, ব্যবসায়িক কার্যক্রম, ইনপুট খরচ এবং অর্ডার ব্যাকলগ সূচকের দ্রুত সম্প্রসারণ রেকর্ড হয়েছে। কর্মসংস্থান সূচক ধীর সংকোচনের হার প্রকাশ করেছে।
উৎপাদন খাত টানা ছয় মাসের সম্প্রসারণ বজায় রেখেছে এবং দ্রুত সম্প্রসারণ হার প্রকাশ করেছে। নতুন অর্ডার, কারখানার উৎপাদন, ইনপুট ক্রয় এবং সরবরাহকারী ডেলিভারি সূচকের দ্রুত সম্প্রসারণ রেকর্ড হয়েছে। তবে নতুন রপ্তানি, সমাপ্ত পণ্য, আমদানি এবং কর্মসংস্থান সূচকের ধীর সম্প্রসারণ রেকর্ড হয়েছে। অর্ডার ব্যাকলগ সূচক দ্রুত সংকোচনের হার প্রদর্শন করেছে।
নির্মাণ খাত টানা তিন মাসের সম্প্রসারণ বজায় রেখেছে, তবে ধীরগতিতে। নতুন ব্যবসা এবং নির্মাণ কার্যক্রম সূচক ধীর সম্প্রসারণ রেকর্ড করেছে, যেখানে ইনপুট খরচ সূচকের দ্রুত সম্প্রসারণ দেখা গেছে। কর্মসংস্থান সূচক সম্প্রসারণে ফিরে এসেছে এবং অর্ডার ব্যাকলগ সূচক ধীর সংকোচনের হার প্রকাশ করেছে।
সেবা খাত টানা পাঁচ মাসের সম্প্রসারণ বজায় রেখেছে, তবে ধীরগতিতে। নতুন ব্যবসা, ব্যবসায়িক কার্যক্রম এবং কর্মসংস্থান সূচকের ধীর সম্প্রসারণ রেকর্ড হয়েছে। অর্ডার ব্যাকলগ সূচক সংকোচনে ফিরে এসেছে এবং ইনপুট খরচ সূচকের দ্রুত সম্প্রসারণ দেখা গেছে। কৃষি, উৎপাদন, নির্মাণ এবং সেবা—সব প্রধান খাতে ভবিষ্যৎ ব্যবসা সূচকের ধীর সম্প্রসারণ রেকর্ড হয়েছে।